যেভাবে মারা গেলেন ‘আয়াতুল্লাহ’র নাতি

এই তো ক’দিন আগের ঘটনা। তখন ভোর ৫টা বাজে। সারি সারি গাছে ঘেরা তেহরানের শরীয়তি অ্যাভিনিউতে পাগলা গতিতে ছুটছিল হলুদ রংয়ের একটি পোর্শে কার। ড্রাইভিং সিটে এক সুন্দরী তরুণী। বয়স কুড়ি হল সবে। পাশের সিটে উপবিষ্ট আছেন ঝকঝকে নতুন গাড়িটির মালিক। ২১ বছরের এই টাকাওয়ালা তরুণ ইরানের সম্মানিত এক পরিবারের সন্তান। শখ হয়েছে, তাই নতুন গাড়ি কিনে বান্ধবীর সাথে প্রমোদভ্রমণে বেরিয়েছেন।

ড্রাইভিংয়ে আনাড়ি হলেও রাস্তায় নেমে মাত্র ১০ সেকেন্ডের ব্যবধানে ১২০ কিলোমিটারে গতি তুললেন তরুণী। গতির সাথে ভোরের মিস্টি বাতাস আর রাস্তার ধারে তখনো জ্বলতে থাকা বাতিগুলোর আলো মিলে এক ঝিলিমিলি পরিবেশ! ভ্রমণকারীরা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। ছয়টি সিলিন্ডারের গগণবিদারী আওয়াজে তখন কেঁপে উঠছিল আশেপাশের এলাকা।

তবে সেই ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগেনি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খায় কারটি। সেখানেই পটল তুলেন চালক তরুণী। মারাত্মক আহত তরুণ মারা যান হাসপাতালে নেয়ার পর।

ঘটনাটা এতটুকুতেই থেমে যাওয়ার কথা ছিল। দুই তরুণ-তরুণীর মৃত্যুতে কিছু লোকজন ‘হায় হায়’ ‘আফসোস’ করে তারপর ভুলে যাওয়ার কথা।

কিন্তু তেহরানের শরীয়তি অ্যাভিনিউয়ের দুর্ঘটনাটি ভুলতে পারছেন না স্থানীয়রা। ঘটনাস্থলের সীমানা পেরিয়ে এটি এখন ইরানের একটি আলোচিত ইস্যু। কারণ একটিই- দেশটির ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজনের কপটতা এবং নানা অপকর্মের জলজ্যান্ত স্বাক্ষ্য দিচ্ছে এই ঘটনা।নিউইয়র্ক টাইমসে শুক্রবার প্রকাশিত In Iran, Fatal Porsche Crash Unleashes Middle-Class Anger at Elites শীর্ষক নিবন্ধে এভাবেই উঠে এসেছে ইরানের বর্তমান চিত্র।

প্রমোদ ভ্রমণে বের হওয়া মোহাম্মদ হোসেইনী রাব্বানী সিরাজী নামের ওই তরুণটি হচ্ছেন, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃত্বধারী এবং ক্ষমতাশালী গোষ্ঠি বলে বিবেচিত এক ‘আয়াতুল্লাহ’র নাতি। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন ওই ‘আয়াতুল্লাহ’।

সাথে থাকা পারিভাস আকবারজাদেহ নামের সুন্দরী মেয়েটি অবশ্য নিতান্ত নিম্নমধ্য বিত্ত পারিবারের একজন। টাকাওয়ালা বন্ধুর সাথে জুটি বেঁধে হয়তো নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সে যাইহোক, মেয়েটিকে নিয়ে নিয়ে প্রমোদভ্রমণ করছিলেন রাব্বানী, অথচ তখন অন্য এক তরুণীর সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে রয়েছে! রাব্বানীর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন ছবি দেখলেই তার বিলাসবহুল জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নব্য ধনী হয়ে ওঠা লোকজনের পরিবারগুলো থেকে নতুন এক ইরানী প্রজন্ম গড়ে উঠছে। এরা স্থানীয়দের মতো চলাফেরা এমনকি কথাও বলে না। তাদের দামী গাড়ি থাকে। থাকে বিয়েবহির্ভূত বান্ধবীরাও। তাদের জন্য দেশের ইসলামি আইনও প্রযোজ্য নয়। এই বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকানো গোষ্ঠিটি ইরানের সমাজে বিদ্যমান চরম বৈষম্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সব কিছুর উর্ধ্বে থাকা এই ‘১ পারসেন্ট’ লোক নিজেদের ইচ্ছামতো টাকা বানাচ্ছে। এর বিপরীতে অর্থনৈতিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকা দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণী দিন আরো কষ্টের মধ্যে নিপতিত হচ্ছে।

রাব্বানী এবং আকবরজাদেহের ঘটনার খবর গত ২০ এপ্রিল ইরানের নাসিমঅনলাইন নামের একটি ওয়েটসাইট প্রকাশ করে। ক্ষমতাবান এবং চুড়ান্ত রক্ষণশীল বলে পরিচিত পারিবারের এক তরুণের প্রমোদভ্রমণে বের হওয়া বিলাসবহুল গাড়ির ধ্বংসাবশেষের ছবি ছড়িয়ে পড়ার সাথে দেশব্যাপী ক্ষোভ ও সমালোচনার ঝড় উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা ওদের মৃত্যুতে সমবেদনা জানানো চেয়ে বরং এটাকে ‘প্রকৃতির বিচার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া দেশটিতে বাড়তে থাকা ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসমতা নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন খবর প্রকাশ করলেও কারা এজন্য দায়ী তা এড়িয়ে যায়। এই দুর্ঘটনার পর নিহতদের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ার পর বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী নিহতদের ব্যাপারে খুবই অশালীন সব মন্তব্য করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

আকবরজাদেহের ইনস্টাগ্রাম পেইজে হীরার আংটি পরে পোজ দেয়া তার একটি ছবির নিচে লিখেছেন, ‘ভালই হয়েছে। এই মেয়ে সাধারণ মানুষের গায়ে আগুন লাগিয়েছিল। এখন তার নিজের গায়েই আগুন দিল।’

এরকম অন্যদের মন্তব্যেও দেশটিতে ক্রমবর্ধমান অসমতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফুটে উঠেছে।

অর্থনৈতিক সাম্যহীনতায় ক্ষব্ধু একজন মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, এই দুনিয়ায় যখন সম্পদ বণ্টনে কোনো ন্যায়বিচার নেই তখন তিনি মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঠিকই ন্যায়বিচার রেখেছেন। আমি আল্লাহর বিচারকে ভালবাসি কারণ, তিনি যেসব গরীব মানুষের জীবনে কোনো আশা-আকাঙ্খা নেই তাদের মতো করেই ধনী এবং তরুণদের জন্যও একই ধরনের মৃত্যু বরাদ্দ রেখেছেন।’

অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তেল, ডলার আর স্বর্ণ বিক্রি করার জন্য সরকারের মনোনীত কিছু লোক আছেন। ‘মিডলম্যান’ বলে পরিচিত এই গোষ্ঠি নতুন নতুন ব্যবসায় নিজেদের জড়ানোর সময় দুর্নীতির সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধা আছে ‘বিপ্লবী দাঁড়ি’ রাখলেও তাদের ছেলেমেয়েদের দুবাইর বড় বড় শপিংমলের দামী কাপড়-কসমেটিকস আর ব্যয়বহুল গাড়ি ছাড়া চলে না। অথচ, দেশটিতে বেশিরভাগ মানুষই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। বহু মানুষ দেশে তৈরি কমদার্মী একটা গাড়িও কেনার সামর্থ্য রাখে না।

গত সেপ্টেম্বরে ইরানের আধাসরকারি নিউজ পোর্টাল ‘মাশরেগ’ জানিয়েছে, দেশটিতে ২০০৯ সালের পর থেকে ১৪০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে অন্তত এক লাখ নতুন বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি হয়েছে। গত বুধবার শহরবন্ধ নামের একটি পত্রিকা জানিয়েছে, অনেক গাড়ির মালিক সুন্দরী মেয়েদের সাথে নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়ান। এই ধরনের বেড়ানোকে স্থানীয়ভাবে ‘দরদর’ বলা হয়।

নাদের করিমী জনি নামের এক সাংবাদিক পোর্শে দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে ফুঁসে উঠা ক্ষোভের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এখানকার নব্যধনীরা চলাফেরা, কাপড়েচোপড়ে ও কথাবার্তায় সামাজিত রীতিনীতিকে পাত্তাই দেন না। তারা নিজেদের ভাল অবস্থানকে দেখিয়ে বেড়ানোর এবং অন্যদের হেয় করে আনন্দ পান।’

ছড়িয়ে পড়া ক্ষোভ প্রশমিত করতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনী মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে এক মিটিংয়ে বলেন, কিছু তরুণ-তরুণী নিজেদের সম্পদের গর্বে রাস্তায় দামী গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা সমাজে মানসিক অনিরাপত্তবোধ তৈরি করছে।’ তিনি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পুলিশকর্তাদের নিদেশ দেন।

জালিয়াতি এবং পছন্দের লোককে সুবিধা দেয়ার বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপের জন্য খামেনী সরকারকেও আহ্বান জানান। ‘দুর্নীতি নিয়ে বড় বড় কথা বলার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই,’ খামেনী বলেন।

অন্য এক বক্তৃতায় এই নেতা বলেন, ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করে চোরকে নিভৃত করা যায় না। আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি দমনে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

আয়াতুল্লাহর এমন বক্তব্যের পর আমিরাবাদ নামে স্থানীয় একটি এলাকার বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির মার্কেটের ব্যবসায়ী হাবিব রাজমানদান বলছিলেন, আমাদের নেতারা যখন এসব গাড়ির বিরুদ্ধে বলেন তখন ব্যবসা তো অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তবে এটা বেশি দিনের জন্য নয় জানিয়ে হাবিব বলেন, ‘টাকাওয়ালাদের ছেলেমেয়েরা এসব গাড়ি কেনা অব্যাহত রাখবেই। কারণ, তারা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ভালবাসে। আর দামী গাড়ি কেনাটা একটা ভাল বিনোয়োগও ধরতে পারেন। যখন এখানে আপনি ধনী হতে পারবেন তখন ভীড় ঠেলে সহজেই বের হয়ে যেতে পারবেন। আপনি তখন ‘বিশেষ কেউ’!



মন্তব্য চালু নেই