ফের ভূমিকম্পে কাঁপলো গোটা দেশ
ঢাকা হবে নরক, তবু নড়ছে না টনক
বিশ্বে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা শহরের তালিকায় শীর্ষে আছে ইরানের তেহরান। আর তারপরই ঢাকা। এই তথ্য জাতিসংঘের। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতেও (সিডিএমপি) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে ঢাকার কথাই বলা হয়েছে। সিডিএমপি ঢাকা শহরের তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের ওপর সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে এর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন মিশে যাবে মাটির সঙ্গে।
ঢাকার ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার কথা বললে বারবারই সামনে আসে পুরান ঢাকার কথা। অথচ সিডিএমপির বলছে ভিন্ন কথা, পুরান ঢাকার বাইরে সচিবালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ভবনও আছে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়।
বিভিন্ন সমীক্ষার বরাত দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভবনই কোনো ধরনের প্রকৌশলীর পরামর্শ বা পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। এসব ভবনে কোনো প্রকৌশল পদ্ধতির ছোঁয়া নেই। যে যার খুশি মতো নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। এছাড়া এখনও যেসব ভবন গড়ে উঠছে সেগুলোতেও ভূমিকম্পরোধ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চিঠি দিয়ে ভবনগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে, দিচ্ছে। এ পর্যন্তই, এর বেশি কিছু হচ্ছে না।
জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘এখন বিশ্বে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে হালকা ইমারত নির্মাণকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অথচ দেশে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা না রেখেই বড় বড় ইমারত নির্মাণ চলছে। এগুলো এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যে, ভূমিকম্প হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ দারুণ ক্ষতির মুখে পড়বে। শুধু তাই নয়, ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে কয়েকগুণ।’
ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভবনই নির্মাণ হয়েছে জলাশয় ভরাট করে বালু-মাটির ওপর। মাটির সঙ্গে এসব ভবনের সংশ্লিষ্টতা খুবই কম। যে কারণে, মাঝারি মাত্রার ভূ-কম্পনে দারুণ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ঢাকার ভবনগুলোকে। সিডিএমপির তথ্য বলছে, ঢাকায় রাতের বেলায় সাত থেকে সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হবেন। দিনের বেলায় হতাহত হবেন ৭০ হাজার।
গত দুই দশক ধরেই বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকির বিষয়টি বেশ আলোচিত। কিন্তু আলোচনার বিপরীতে প্রস্তুতি একেবারে কম। মাঝেমাঝে কিছুটা মৃদু ভূ-কম্পন অনুভূত হলে এনিয়ে কিছু আলোচনা হয়। কিছুদিন এনিয়ে কথা। পরে আবারও চলে যায় আলোচনার বাইরে।
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, পুরান ঢাকার ভবনগুলো নিয়ে খুব বেশি মতামাতি হওয়ার কারণে ঢাকার অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চলে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। অথচ ঢাকার অন্যান্য এলাকার চেয়ে পুরান ঢাকার মাটি তুলনামূলক শক্ত। যে কারণে ভূমিকম্প আঘাত হানলে পুরান ঢাকার চেয়ে অন্য এরাকায় ক্ষতি বেশি হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানায়, ঢাকা মহানগরীর ৫৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১২ লাখ ৫০ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শহরেই আছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন। আর ঐতিহ্যবাহী ভবন আছে ২২৯টি। এছাড়া মারাত্মক ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এর মধ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে গড়ে ওঠা প্রায় ৫ হাজার বহুতল ভবনকে চিহ্নিত করেছে রাজউক।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ ভবন জলাশয় ভরাট করে বালু-মাটির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে, যা মাত্র ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও সহনীয় নয়।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিমে জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা ভবনগুলো চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশের একশ থেকে দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হলে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারত, তা কল্পনাও করা যাবে না। শুধু ঢাকায় ভূমিকম্পে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে। সারাদেশে ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। মহাখালী ফ্লাইওভার ছাড়া আর কোনো ফ্লাইওভারই ভূমিকম্প-সহনীয় নয় বলেও জানান তিনি’।
মন্তব্য চালু নেই