আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ

ইরানের সফল চুক্তিতে বেসামাল নেতনিয়াহু

কিছুদিন আগেই ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জাতীয় সাধারণ নির্বাচন। গেল কয়েকবারের মতো এবারও ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টিই জয়লাভ করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোষ্ট ভোটের আগেই সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থীর নামের পাশে নেতানিয়াহুর ছবি সেটে দিয়েছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবির দক্ষতা এবং প্রভাবের উপর দেশটির নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করলেও এবারের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জিতে যাওয়া ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা আমরা নির্বাচনের আগে নেতানিয়াহুকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার করা কিছু বক্তব্য শুনলেই দেখতে পাই।

দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষত আরব বসন্ত পরবর্তীতে লিকুদ পার্টির মার্কিন লবিস্টরা নেতানিয়াহুকে আরব প্রশ্নে অবস্থান নেয়ার কথা বলে আসছিল। কিন্তু মিসরে গোলযোগ চলাকালীন সময়েও যেমন কার্যত ইসরায়েল নিশ্চুপ ছিল তেমনি ইয়েমেন প্রশ্নেও তারা দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে পরিষ্কার করছে। আর এই অবস্থান নিয়েই ওবামা সমালোচনার ছিদ্র পথে লিকুদ পার্টির বিপক্ষ জিওনিস্টদের সমর্থন দানের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যদিও তা শেষমেষ ইরান ইস্যুতে মার্কিন-ইসরায়েল লবিস্টরা জিওনিস্টদের পক্ষে সমর্থন তুলে নেয়। মোটকথা, এবার নেতানিয়াহুকে জেতানোর পেছনে সবচেয়ে বেশি কাঠখড় এবং মাঠে নামতে হয়েছে বিদেশি লবিস্টদের।

ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থন আসে মূলত মিঝরাহি বা মধ্য পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল থেকে। অপরদিকে জিওনিস্ট ইউনিয়নের শক্তি এবং সমর্থনের অন্যতম উৎস ইউরোপীয় ইহুদি কমিউনিটি। বর্তমানে ইউরোপে ইহুদি-আমেরিকান সেক্যুলার এবং ধর্মীয় দলগুলো কিছুটা কোনঠাসা থাকার কারণে জিওনিস্ট ইউনিয়নের পক্ষে মার্কিন সমর্থন আদায় কিছুটা কষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে ‘আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি(এআইপিএসি)’ এবং অন্যান্য দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে থাকার পরেও রিপাবলিকান সিনেটরদের ইসরায়েলের স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষে আনতে পারেনি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্যোগী করে ইসরায়েলের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসে জিওনিস্ট ইউনিয়ন।

কিন্তু ঘটনা হলো, ছয় দেশের সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে ইসরায়েলে আভ্যন্তরীন কোন্দলের দেখা দিয়েছে। এর আগে অ্যারিয়েল শ্যারনের সময়েও একবার অন্তর্কোন্দল শুরু হলেও তা লিকুদ পার্টির উচ্চপদস্থদের হস্তক্ষেপে সমাধান হয়। কিন্তু এবার লিকুদ পার্টি বনাম জিওনিস্ট ইউনিয়নের অবস্থান মুখোমুখি হয়ে যাওয়াতে কোনো পক্ষকেই প্রকাশ্যে সমঝোতার রাস্তায় আসা সহজ হচ্ছে না। মিঝরাহির সমর্থকরা ইতোমধ্যেই এই পরমাণু চুক্তি সফলভাবে হওয়ার জন্য নেতনিয়াহুকে দোষারোপ করে আসছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মিঝরাহিরা নেতানিয়াহুকে সেজন্যই সমর্থন দেয় যাতে নেতানিয়াহু স্বাধীন ইসরায়েলের সকল স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইসরায়েলের অধিকাংশ কট্টরপন্থী ইহুদি সংগঠনের উৎপত্তি এই মিঝরাহি অঞ্চল থেকে। জিওনিস্টরাও কট্টরপন্থীদের মদদ দিয়ে আসছে, তবে তা এখনও লিকুদ পার্টির মতো দৃশ্যমান নয়।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি ভূমি অধিগ্রহনের সময় অনেক আরব ভাষিক ইহুদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকা থেকে ইসরায়েলের মিঝরাহিতে অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। এই বিশাল গোষ্ঠিকে নিজস্ব ভূমি অধিগ্রহন করার বদলে ক্রমশ পূবের দিকে শ্যানটিটাউনের ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে এই অভিবাসীরা ইউরোপের যোগাযোগ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিন করে লেবার পার্টির। পাশাপাশি মিঝরাহির অভিবাসীরা তাদের আশার প্রতিফলন দেখতে পায় লিকুদ পার্টির অভ্যন্তরে। যদিও তৎকালীন লিকুদ পার্টির প্রধান নিজে ছিলেন পোলিশ। করিৎকর্মা এবং বিপক্ষ শিবিরে ফাটল ধরাতে ওস্তাদ এই নেতার নেতৃত্বে শেষমেষ ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয় লিকুদ পার্টি। পরবর্তী ত্রিশ বছরের ইতিহাসতো মোটামুটি সবারই জানা।

একেবারে নিখুত জনসংখ্যা বলা না গেলেও বর্তমান ইসরায়েলের অর্ধেক জনগোষ্ঠিই কিন্তু মিঝরাহি গোষ্ঠির। এই গোষ্ঠির মধ্যে যদিও মিঝরাহি নয় এমন কিছু গোষ্ঠিও আছে তবে তারা লিকুদ পার্টির নীতিকেই সমর্থন করে। যেহেতু মিঝরাহিদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইউরোপ থেকে বঞ্চিত হবার তাই লিকুদ পার্টিকে বরাবরই তারা ইউরোপের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেতে চেয়েছে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লিকুদ পার্টি চাইলেও সরাসরি আন্তর্জাতিক কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারছে না একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া। আর ফিলিস্তিনিদের উপর এই মুহূর্তে বিনা কারণে চড়াও হওয়া সম্ভব নয় যেহেতু হাতের কাছ থেকে ইরান ফস্কে যাচ্ছে।

লিকুদ পার্টির এই উভয়সঙ্কটই হতে পারে তার কাল। অথবা এমনও হতে পারে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ইতিহাসে এবারই লিকুদ পার্টির শেষ বিজয়। ইরানের পরমাণু চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা শান্তিচুক্তি, ইয়েমেনে অসন্তোষ এবং তেলের মূল্য বৃদ্ধির ইস্যু ইতোমধ্যেই লিকুদ পার্টিকে মিঝরাহিদের মাঝে সমালোচনায় ফেলে দিয়েছে। তাই আগামীতে মিঝরাহিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে জিওনিস্ট ইউনিয়নকেও দেখা যেতে পারে রাষ্ট্রক্ষমতায়।



মন্তব্য চালু নেই