স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছে হংকং?
হংকং কি ক্রমেই স্বাধীনতাকামী হয়ে উঠছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ অন্তর্জালিক ভোটের ফলাফল কিন্তু সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। দেশটিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে শেষ অব্দি বিস্তৃত আন্দোলন সাফল্যের মুখ না দেখলেও, সেটি যে অভ্যন্তরে এখনও আগুন পুষে রেখেছে, সাম্প্রতিক অন্তর্জালিক নির্বাচন তা প্রমাণ করে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বিভাগের ছাত্রপরিষদ দ্বারা পরিচালিত একটি পত্রিকার উদ্যোগে ভোটাভুটিতে অংশ নিয়েছিল ৫৬৯ জন ছাত্র। তাদের ২৮ শতাংশ হংকংকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এ সংখ্যাটি গত বছরেও ছিল ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত মাসের চেয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা তরুণতরুণীরা বেড়েছে ১৩ শতাংশ। হংকং গত সহস্রাব্দ থেকে ‘এক দেশ দুই নীতি’ নামক একটি বিসংবাদিত নীতিতে পরিচালিত প্রদেশ ছিল এবং এখনও এ প্রশাসনিক কাঠামো বজায় আছে।
‘এক দেশ দুই নীতির’ প্রতি তরুণতরুণীরা আস্থা হারাচ্ছে ক্রমশ। ভোটের ফলাফলে দেখা যায় ৫৩ শতাংশ ভোট পড়েছে গণতন্ত্রের জলে সংশোধিত ‘এক দেশ দুই নীতি’র পক্ষে। উল্লেখ্য, জানুয়ারির ২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ৫ তারিখ পর্যন্ত পরিচালিত নির্বাচনে ঐ নীতির পক্ষে ভোট পড়েছিল ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ‘এক দেশ দুই নীতির’ প্রতি সমর্থন তুলে নিয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ তরুণতরুণী।
হংকং আন্দোলনের নেতা লিয়াং চান ইং গত বছর একাধিক আপোসকামী সিদ্ধান্তের কারণে বিতর্কিত হয়েছিলেন। এবার এ নির্বাচনের ফলাফল দেখে তিনি আবারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণকারীদের সংখ্যা না আবার বেড়ে যায়। তিনি নিজে ‘এক দেশ দুই নীতির পক্ষে’ এবং স্বাধীন হংকং এর স্বপ্ন তিনি দেখেন না। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্ভবত বেউজিং এর সার্বভৌমত্ব হরণের লক্ষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৈরি করছে। তবে স্নাতক বিভাগের ছাত্রপরিষদ পরিচালিত পত্রিকাটির বিষয়ে তার মন্তব্য, এটি শুধুমাত্র মতামত জানার মানসে এ নির্বাচন পরিচালনা করেছে এবং এ উদ্যোগ সন্দেহজনক কিছু নয়।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে লিয়াং সন্দেহজনক কিছু না দেখতে পেলেও, এটি যে ভবিষ্যত আরও আগ্রাসী আন্দোলনের একটি পূর্বসংকেত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই অনেক বিশ্লেষকের। জানা যাক উঠে আসা আরও কিছু পরিসংখ্যানের কথা। গত বছর পরিচালিত একটি জরীপে অহিংস শান্তিপূর্ণ সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন ৭৬ শতাংশ ছাত্র। এবার দেখা গেছে তা নেমে প্রায় ৩৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বছরই অহিংস বিক্ষোভ-র্যালি পরিচালনার পক্ষে রায় দিয়েছিল ৩৭ শতাংশ। এবার তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে।
সবচেয়ে কার্যকর বিক্ষোভ-পদ্ধতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে হরতাল, সরকারী ভবন দখল, সমাবেশ, রাজপথ অবরোধ, পদযাত্রা এবং দফায় দফায় এ ধারার মতপ্রচারক নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে হংকং এর ছাত্ররা শিগগিরই এ সকল পন্থা অবলম্বন করে পূর্ব্বতন Umbrella Movementকে আবারও চাঙা করতে চাইবে। বেইজিং অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্কতামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে চাইবে, যেন ১৯৮৯ সালের মতো আবারও হংকং এর ছাত্র আন্দোলন ঠেকিয়ে দেয়া যায়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য হংকং ১৯৯৭ সালে চীনের অধীনে ‘এক দেশ দুই নীতি’ পন্থা অবলম্বন করে। প্রদেশটির সংসদ নির্বাচনের প্রতিনিধি কারা হবে তারা বেইজিংই ঠিক করে দিয়ে আসছে সেই থেকে। হংকং এর ছাত্রছাত্রীরা আশু নির্বাচনকে সামনে রেখে যেন এই নীতি গৃহীত না হতে পারে সে লক্ষে ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টম্বর রাজপথে নেমে আসে। ডিসেম্বর ১৫ তারিখে বেইজিংএর মদদপুষ্ট হংকং প্রশাসন ছাত্রদের আন্দোলন থেকে চূড়ান্তভাবে বিচ্যূত করে।
সাবেক এ ব্রিটিশ উপনিবেশটি হয়ত সামনের দিনগুলোতে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে আবারও। ব্রিটিশরা যত দেশে এ যাবত উপনিবেশ গড়েছে, ভারতবর্ষসহ প্রায় প্রত্যেকটিতে বিসংবাদের বীজ সাফল্যের সঙ্গে বুনে দিয়ে গেছে। পরবর্তীতে নবতর শাসনব্যবস্থা; যেমন সমাজতন্ত্র; সংসদীয় গণতন্ত্র; এসেও ঐ বিসংবাদসমূহ দূর করতে পারেনি এবং ঐ দেশসমূহে অবস্থানরত জাতিগুলোকে শতকজুড়ে ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে যুঝতে হয়েছে।
সর্বশেষ উদাহরণ হংকং এর আমব্রেলা ম্যুভমেন্ট। নির্বাচন পদ্ধতিতে যে নীতিগত পরিবর্তন আনার জন্যে এবং সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত ব্যক্তিত্বদের অপসারণের জন্যে মূলত ঐ আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, তাতে কোনো সাফল্যই একরকম অর্জিত হয়নি। বিতর্কিত বেইজিং-নির্বাচিতরা এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। উপরি ১৯ জানুয়ারী প্রকাশিত এক রাষ্ট্রীয় নথি থেকে জানা যায় ৯৫৫ জন ছাত্রছাত্রী এখনও গ্রেপ্তার আছেন। একটি ব্যর্থ আন্দোলনের ছাইচাপা আগুন ক্রমশ জড়ো খড়কুটোয় দাবানল হওয়ার অপেক্ষায় আছে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
মন্তব্য চালু নেই