মমতার ঢাকা সফরে কী পেল পশ্চিমবঙ্গ!
মমতার ঢাকা সফরে কী পেল পশ্চিমবঙ্গ, এমন প্রশ্ন উঠেছে ওপারের কোনো কোনো মিডিয়ায়। মমতার ঢাকা সফর শেষে রাজ্যের পাওনা শূন্যই মনে করছেন কেউ কেউ। কিন্তু আসলেই কী এমন ভাবনা যথার্থ। আসলেই কী অর্জন শূন্য?
রোববার কলকাতার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে এই সফর সম্পর্কে মন্তব্যে বলা হয়, ‘গত তিন দিন ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরকে ঘিরে বাহ্যিক উচ্ছাস, আন্তরিকতা এবং সৌজন্যের কোনও অভাব ছিল না। আজকের বৈঠকেও দিদি শেখ হাসিনা তাঁর বাসস্থান ‘গণভবনে’ ঢালাও আপ্যায়ন করলেন তাঁর ছোট বোন মমতাকে। মাঝরাতে ঐতিহাসিক শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর যে ভাবে প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছু’টে গিয়েছিলেন একে অপরের দিকে, গোটা দিন সেই সুর বেজে গিয়েছে মমতার ফিরতি বিমান ধরা পর্যন্ত। কিন্তু, এ সবের পরেও একটি প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে, সরকারি অর্থে পাত্র-মিত্র-অমাত্য নিয়ে মমতার এই ঢাকা সফরে রাজ্য কী পেল?’
মন্তব্যে ওই দৈনিকটিতে পাওনার প্রশ্ন তুলে আরো বলা হয়, ‘ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরনের বাড়িতে চা-চক্রের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রতিনিধি দলের খোশগল্প ও গানবাজনা অথবা দুপুরের বৈঠকি আড্ডায় মনভরানো বিচিত্রানুষ্ঠান হলেও, রাজ্যের পাওনার ঘরে কিন্তু বলার মতো কিছুই নেই। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যৌথ উদ্যোগে সিনেমা তৈরি নিয়ে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সেরেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী অভিনেতা প্রসেনজিৎ ও পরিচালক গৌতম ঘোষ। দুই বাংলার মধ্যে যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্র নির্মাণ, কালকাতায় বাংলাদেশি ছবির উৎসব-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুব শীঘ্রই উদ্যোগ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রসেনজিৎ। কিন্তু এই আলোচনার বিষয়টিও নতুন নয়। বছর তিনেক ধরেই চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী প্রযোজকের বাধায় কিছুই এগোচ্ছে না।’
আরো বলা হয়, ‘দু’দেশের বণিকসভার সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠক হল। তাতে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ থেকে শুরু করে উপস্থিত ছিলেন দু’পক্ষের বহু বাণিজ্য কর্তা। কিন্তু গোটা আলোচনাটিই ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এবং তিস্তা-ছিটমহলের দাবিদাওয়ার চড়াতেই গিয়ে ঠেকলো। কোনও নির্দিষ্ট বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হল না। দু’দেশের বিমানবন্দরে পারস্পরিক দোকান করার মত কিছু অকিঞ্চিৎকর মৌখিক প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী দিলেও, তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হল না।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের বিমানে ওঠার আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তৃণমূল-জামাত যোগাযোগ নিয়ে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে ঢাকার মন জয় করতেই তাঁর এই সফর। বাংলাদেশের নেতৃত্ব তাদের আচার ব্যবহারে সন্দেহের কোনও বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই দেখাননি। আজও প্রোটোকল বহির্ভূত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বিদায় দিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দাঁড়িয়ে থেকেছেন যত ক্ষণ না গাড়ি ছাড়ে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দিুল হামিদ তাকে বলেছেন, পরের বার এসে হোটেলে নয়, তার বাড়িতেই যেন আতিথ্য নেন মমতা। তিস্তা নিয়ে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলে এসেছেন মমতা।
এ প্রসঙ্গে কলকাতার এই মিডিয়ায় বলা হয়, ‘তিনি (মমতা) হয়তো ভাবছেন, এই আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হলে তার দলের বিরুদ্ধে ওঠা জামায়াত যোগের অভিযোগ নিয়ে খোঁচাখুঁচি করা হয়তো বন্ধ করবে ঢাকা।’
কলকাতার আরেকটি বহুলপঠিত দৈনিকে রিপোর্টে মন্তব্যের সুরে বলা হয়, এপারের বাঙালির পাতে ওপারের ইলিশ কি আসবে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে আশার আলো দেখছে এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ থেকে মৎস্য ব্যবসায়ী সংগঠন। তাদের কাছে খবর, বৈঠক বেশ ভাল হয়েছে। আর তাই তারা এখন থেকেই আশা দেখতে শুরু করেছেন যে বছর তিনেকের খরা কাটিয়ে আবার রাজ্যে আসতে শুরু করবে বাংলাদেশের ইলিশ। মৎস্য ব্যবসায়ীরা মনে করেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন তার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে ইলিশ মাছের ওপর। তারা বলছেন তিস্তা চুক্তি যদি হয়ে যায় তা হলেই ইলিশ মাছ পাওয়া যাবে। তিস্তা চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ইলিশ মাছ রাজ্যে পাঠানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলবে না।
আরো বলা হয়, এখন ইলিশ বলতে আসে মায়ানমারের হিমায়িত (ফ্রোজেন) ইলিশ। স্বাদে গন্ধে যা বাঙালির কাছে অপাংক্তেয়ই। মায়ানমারে ইলিশের মরশুম শুরু হয় পুজার পর। তাই ইলিশ মাছ খাওয়ার যে চিরাচরিত সময় তখন ইলিশ মেলে না। কিন্তু এবার যদি বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া যায় তা হলে সারা বছরই ইলিশ খেতে পাওয়া যাবে।
অথচ ভাষা দিবসের ঐতিহাসিক আবেগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় তলানিতে পৌঁছে যাওয়া সম্পর্ক চাঙ্গা করার লক্ষ্যেই যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই সফর এটা কার না জানা। সেখানে যে সম্পর্কের উষ্ণতা তৈরি হল, যে দূরত্বের সীমানা ঘুচল, যে আলাদা এক বন্ধনের সূত্রপাত হল- এটাই কম কীসে? মমতা তো এটুকুই চেয়েছিলেন। সম্পর্ককে যে দূরত্বে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে সম্পর্কটা ফিরে পাওয়াটাই ছিল মমতার প্রধান চাওয়া। সে চাওয়ায় তিনি যথার্থই সফল হয়েছেন। তবে এর বাইরে আর কী পেতে চাইছেন তারা? বরং তারাই তো দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করে আসছেন বাংলাদেশকে। তারপরও তাদের প্রতি বাংলাদেশের ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম।
শনিবার গণভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে মমতা ও তার সফরসঙ্গীরা নানাপ্রকার ইলিশ ব্যঞ্জণায় মুগ্ধ হন। খাবারের আয়োজনে ছিল ইলিশের প্রাধান্য। মধ্যাহ্ন ভোজের শুরুতেই স্মোকড ইলিশ (ভাপা ইলিশ), ওনিয়ন রিং, ক্যাপসিকাম এবং বন রুটি ও মাখন পরিবেশন করা হয়। এরপর মূলপর্বে কালি জিরা চালের ভাত, বিভিন্ন সবজির তরকারি, চিংড়ির মালাইকারি, রূপচাঁদা ভাজা, ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ মাছের ডিম ভাজা, চিতল মাছের কোপ্তা, রুই মাছের তরকারি, খাসির রেজালা ও হাড়ছাড়া মুরগির মাংসের। পরে ছিল কুমিল্লার রসমালাই এবং মিষ্টি দই।
তার আগে বৈঠকে মমতা বৈঠকে শেখ হাসিনার কাছে তার রাজ্যে ইলিশ না পাওয়ার অনুযোগ তুলে ধরেন। বলেন, ‘ইলিশ খুব কম পাচ্ছি’। জবাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পানি আসলে ইলিশও যাবে।’ বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বস্ত করেন, ‘তিস্তা চুক্তির জট অচিরেই কেটে যাবে’। কতটা আন্তরিক পরিবেশ পেলে এমন আলোচনা সম্ভব, তা সহজেই অনুমেয়।
আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের আগেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এসে কুশল বিনিময় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা সফরে আসা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রটোকল ভেঙ্গেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন দুই নেত্রী। রাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের কয়েক মিনিট পরই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান মমতা। বলেন, ‘হৃদয়ের মধ্যে একটা আলোড়ন হচ্ছে। এটা কথায় বলে বোঝানো যাবে না। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
এসময় মমতা বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি। আমরা ওপার বাংলায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি। আমি যখন এমপি ছিলাম। তখন একটা স্মারক তৈরি করেছিলাম। সেটা প্রতি বছর আমরা সেলিব্রেট করি।’ মমতা বলেন, ‘এখানে উপস্থিত থেকে, এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা আমাদের হৃদয়ে আবেগ সঞ্চার করে। ফিরে আসা দিনগুলোকে ফিরে দেখতে সাহায্য করে।’একুশে ফেব্রুয়ারি সমস্ত ভাষার মানুষের মাঝেই গর্বের সঞ্চার করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসব টুকরো টুকরো পাওয়া, মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার অনুভূতি, অকৃত্রিম ভালবাসায় আপ্যায়িত হওয়া নিঃসন্দেহে বিরাট পাওনা। যা মমতা ও তার সফরসঙ্গীদের মনে পড়বে অনেক অনেক দিন।
মন্তব্য চালু নেই