হারিয়ে যাওয়া ২২ ধনী পরিবার

১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি বণিক পরিবারের কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে দুটি পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে। একটি হলো এ কে খান পরিবার। অন্যটি ইস্পাহানি (অবাঙালি) পরিবার। এর বাইরে আরও অর্ধশতাধিক জমিদার পরিবার ছিল। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে এসব পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও বর্তমানে তারা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে!খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৯-৭০ সালে শীর্ষ ১০ বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা পরিবারের শীর্ষে ছিল এ কে খান পরিবার। এই পরিবারের ১২টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল। সম্পদের পরিমাণ ছিল আনুমানিক সাড়ে ৭ কোটি রুপি। দ্বিতীয় স্থানে, ছিল গুলবক্স ভূঁইয়া পরিবার। তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল ৫টি। আর সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ কোটি রুপি। তৃতীয় স্থানে থাকা জহুরুল ইসলাম ও তার ভাইদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি রুপি, তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল ১৪টি।

চতুর্থ স্থানে থাকা মো. ফকির চাঁদ পরিবারের ৯টি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি রুপি। পঞ্চম স্থানে ছিল মকবুল রহমান ও জহিরুল কাইয়ুম পরিবার। এ পরিবারটির ৬টি প্রতিষ্ঠান ছিল। আর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি রুপি। ষষ্ঠ স্থানে থাকা আলহাজ মুসলিমউদ্দিনের পরিবারের ৬টি প্রতিষ্ঠান ও ৫ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। সপ্তম স্থানে ছিলেন আলহাজ শামসুজ্জোহা পরিবার। তাদের ৪টি প্রতিষ্ঠান ও ৫ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। অষ্টম স্থানে ছিলেন খান বাহাদুর মুজিবর রহমান। ওই সময় তার পরিবারের ৫টি প্রতিষ্ঠান ও সাড়ে ৪ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। নবম স্থানে থাকা আফিলউদ্দিন আহমেদ পরিবারের ৪টি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের সম্পদ ছিল ৪ কোটি রুপি। দশম স্থানে থাকা এমএ সাত্তার পরিবারের ছিল ৫টি প্রতিষ্ঠান। তাদের সম্পদ ছিল ৩ কোটি রুপি।

তৎকালীন ধনীদের সম্পদের হিসাব করা হয়েছে আনুমানিক সম্পত্তির ভিত্তিতে। আর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স প্রকাশিত মেম্বার ডিরেক্টরির তথ্য বিশ্লেষণ করে সাজানো হয়েছে ১৯৮৮ সালের শীর্ষস্থানীয় শিল্প ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর তালিকা।

এসব ধনীদের বাইরেও বনেদি পরিবার ছিল। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের রাউজানের তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আনোয়ারা উপজেলার আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পরিবার। তার বাবা ছিলেন জমিদার নুরুজ্জামান চৌধুরী। এছাড়া বনেদি পরিবারের অন্যতম ছিল নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার।

এর বাইরে বিপুল অর্থের মালিক ছিল তেওতা জমিদার পরিবার। তেওতা জমিদারির আওতাভুক্ত ছিল ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা এবং দিনাজপুরসহ রংপুর ও বর্ধমানের কিছু অংশ। ১৯১৪ সালে এই পরিবারের দিনাজপুরে থাকা সম্পত্তির মূল্য ছিল ১১ লাখ টাকারও বেশি। তখন এই পরিবার ৬০ হাজারেরও বেশি টাকা কর দিতো।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে একসময় প্রভাব বিস্তার করা ফরিদপুরের জমিদার পরিবার। এর একটি কীর্তিপাশা জমিদার পরিবার। তারা ঝালকাঠি জেলার বৈদ্য বংশীয় জমিদার। বরিশালের মাধবপাশা জমিদার পরিবারও ধনী ছিল। বর্তমানে জমিদার পরিবারগুলো অবস্থা বেশ নাজুক। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অধিকাংশই এখন বেদখল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার বকুল কিশোর আচার্য চৌধুরীর (ডাবল এমএ) পরিবারটির সংসার চলছে সুপারি ও নারিকেল বিক্রি করে। এই পরিবারের সদস্য শ্রিপ্রা আচার্য চৌধুরী বলেন, ময়মনসিংহের ভালুকা, গফরগাঁও, গাজীপুর, জয়দেবপুর, বগুড়া, বরিশাল, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে এখনও তাদের সম্পত্তি রয়েছে। তবে সেগুলো তাদের হাতছাড়া।

একইভাবে পাকিস্তানের ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই, ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী এবং গুল মোহাম্মদও এখন ইতিহাস। আদমজী পরিবার যৌথভাবে ১৯৫০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৪ দশমিক ৮৮ একর জমিতে গড়ে তোলে আদমজী জুট মিলস।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জানান, ‘পাকিস্তান আমলে ২২টি ধনী পরিবার থাকলেও বাঙালি কোনও ধনী পরিবার ছিল না বললেই চলে। স্বাধীনতার পর থেকে ধনীরা এ দেশ থেকে চলে যাওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে অন্যতম আদমজী গ্রুপ। এছাড়া অনেকেই চলে গেছে স্বাধীনতার পর। ইস্পাহানির পরিমাণ যায়নি। তবে তাদের ব্যবসাও বাড়েনি।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনকার ধনীরা সেই ২২ পরিবারকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এখন কয়েকশ ধনী পরিবারের বসবাস এ দেশে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও অনেকে ধনী হয়েছেন। এ কারণে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে ধনী পরিবারগুলো। স্বাধীনতার পর তারা ব্যবসা গুটিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। স্বাধীনতার পর দেশের অনেকেই সেইসব ব্যবসার হাল ধরেছেন। ওই সময় অনেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হয়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকেই প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করে সফলতা দেখিয়েছেন। পাকিস্তানের বড় ব্যবসায়ী ধনীরা মূলত চা এবং পাটের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ব্যবসার ধরন বদলেছে। ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণ সুবিধাও পেয়েছেন। পাশাপাশি তাদের দক্ষতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে যোগ্যরাই এ দেশে ধনী পরিবার করতে পেরেছেন।’

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স প্রকাশিত মেম্বার ডিরেক্টরির তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে জহুরুল ইসলাম গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদার ব্যবসার মাধ্যমে গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেন জহুরুল ইসলাম। ১৯৮৮ সাল নাগাদ এ গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়ায় ৬২৮ কোটি টাকায়। এ সময় গ্রুপের অধীনে ছিল ২৪ প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় নম্বরে ছিল ইস্পাহানি গ্রুপ।

আশির দশকে এএসএফ রহমান প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো গ্রুপ ছিল তালিকার তৃতীয় স্থানে। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫২৪ কোটি টাকা। চতুর্থ স্থানে ছিল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনের আনোয়ার গ্রুপ। পঞ্চম স্থানে থাকা এ কে খান গ্রুপের টার্নওভার ছিল ৪০০ কোটি টাকা। ষষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী পরিবার ছিল মুহাম্মদ ভাই। সপ্তম স্থানে লতিফুর রহমানের ডব্লিউ রহমান জুট, অষ্টম স্থানে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর এপেক্স, নবম স্থানে এম মোর্শেদ খানের প্যাসিফিক এবং দশম স্থানে ছিল স্যামসন এইচ চৌধুরীর স্কয়ার গ্রুপ।

ব্যাংকিং খাতের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে (১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত) এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (মে ১৯৮১) সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৯৮। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি সঞ্চয় রয়েছে এমন হিসাবধারীর সংখ্যা ৬০ হাজার। দিনবদলের সঙ্গে অর্থনীতি বড় হয়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে সম্পদশালী পরিবারের সংখ্যাও।

বর্তমানে শীর্ষ ধনীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এর মধ্যে আছেন ‘বিজনেস মোগল’ নামে পরিচিত ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসের। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তিনিই বাংলাদেশের শীর্ষ ধনী। তার সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা)।

এছাড়া তালিকায় আছেন বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমান। বেইজিংয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন গ্লোবালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তার অবস্থান ১৬৮৫তম। বাংলাদেশের কোনও ব্যবসায়ী এই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় উঠে আসলেন। তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৩০ কোটি ডলার।

ধনীদের তালিকায় আরও আছেন বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আকবর সোবহান, পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, গাজী গ্রুপের গোলাম দস্তগীর গাজী, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, ইস্ট-কোস্ট গ্রুপের মালিক আজম জে চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, এস আলম গ্রুপের সাইফুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যক্তি। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল, টিভি চ্যানেল, ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক তারা।

এর বাইরেও নতুন নতুন শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২ কোটি টাকা বা এর বেশি টাকার সম্পদের মালিক এখন ১৭ হাজার ৩৯ জন।



মন্তব্য চালু নেই