খালেদাকে চাপে রাখার কৌশলে সরকার

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চারদিক থেকে মানসিক চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করার মতো বাস্তবতা তৈরি হলেও তাকে আটক না করে নিজ কার্যালয়ে একপ্রকার ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। সরকার মনে করছে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলে দেশ-বিদেশে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যাবে এবং সরকারের উপর উল্টো চাপ বাড়বে। তাই নানা কায়দায় তার উপর মানসিক চাপ তৈরি করে চলেছে সরকার। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা যায়।

জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে মানসিকভাবে চাপে রাখতে বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে তাকে অবরুদ্ধ রেখে তার সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের যোগাযোগ বিচ্ছন্ন রাখা, তাকে হুকুমের আসামি করে জেলা জেলায় তার নামে মামলা দেয়া, কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা দেয়া, কারো সঙ্গে দেখা করতে না দেয়া, কার্যালয়ের আশপাশে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশে করা এবং কারাগার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার খবর তার কানে পৌঁছানোসহ নানামুখি কৌশল।

সরকারের অনেক নীতি নির্ধারক মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে অব্যাহতভাবে তৃণমূল নেতাদের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে পারলে আন্দোলন অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ তিনি যোগাযোগ করতে না পারলে তৃণমূল নেতাতর্মীরা কোনো নির্দেশনাই পাবে না। তাতে আন্দোলনের মানসিকতা হারিয়ে ফেলবে নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে না পারলে আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে পারবেন না খালেদা জিয়া। এর ফলে দলের অন্য নেতাদের নতুন কৌশল ও দিক নির্দেশনাও দিতে পারবেন না। এতে করে খালেদা জিয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।

অনেকে মনে করছেন, বিভিন্ন জেলা থেকে যেভাবে হুকুমের আসামি করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে তা অব্যহত থাকলে বিএনপির অন্য নেতারাও হামলা-মামলার ভয়ে আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসবে। তাই সরকার চাচ্ছে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার না করে বরং তার আশপাশে যারা আছেন তাদের আইনের আওতায় এনে তাকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করে রাখতে।

এই কৌশলের বাইরে বিভিন্ন পেশাজীবীদের একত্র করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এ কারণে শ্রমিক, পরীক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে দিয়ে বিএনপির চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে মানবন্ধন, প্রতিবাদ সভা ও সমাবেশ করে যাচ্ছে সরকার সমর্থিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন।

এদিকে হঠাৎ করেই কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিআইপি ভবন দু’টো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলা হয়েছে। কারাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের চিন্তাভাবনা সরকারের নেই। তাকে যেভাবে হোক আগে কার্যালয় থেকে বের করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারপর তদন্ত হবে। তদন্ত করে তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এটা একটা আইনি বিষয়, যা প্রক্রিয়াধীন।’

খালেদার কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কার্যালয় তো খাওয়ার জায়গা নয়। আমরা জানি কার্যালয় হচ্ছে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জায়গা। তিনি (খালেদা) কেন সেখানে পড়ে থাকবেন?’

তবে সরকার চাচ্ছে খালেদা জিয়াকে কার্যালয়ে নয় তার বাসায় একঘরে করে রাখতে। কারণ তিনি বাসায় থাকলে দল থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। সে জন্য কার্যালয় থেকে বের হতে খালেদাকে বারবার সুযোগও দেয়া হচ্ছে। এমনকি প্রশাসন ও আওয়ামী লীগে নেতারাও বলছেন, তিনি বাসায় গেলে তাকে কোনো বাধা দেয়া হবে না, উল্টো সাহায্য করা হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া সরকারকে সে সুযোগ দিতে চান না। তিনি মনে করেন কার্যালয় থেকে বের হলে দলীয় কার্যালয়ের মতো তার রাজনৈতিক কার্যালয়ের অবস্থাও ‘ভূতুড়ে’ হয়ে যেতে পারে।

সে কারণেই তার দলের ডাকা হরতাল-অবরোধে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় শতাধিক প্রাণহানী, বিশ্ব ইজতেমা, মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুও তাকে টলাতে পারেনি। খালেদা জিয়া ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কার্যালয়েই থাকতে চান তিনি। আর সে কারণেই এবার নিজ দলের সঙ্গে ভাষাশহীদদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যাননি খালেদা জিয়া।

বিএনপি চেয়ারপারসন কেন শহীদ মিনারে যাননি জানতে চাইলে দলটির সহ-সভাপতি বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘কীভাবে যাবেন? সরকার ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) অবরুদ্ধ করে রেখেছে।’

বেগম খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে যেতে পারেননি, এতে জনমনে কোনো প্রভাব পড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণ ভালো-মন্দ সব বুঝে।’

বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার সহকারী প্রেস সচিব ও বিএনপির সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন তার কার্যালয় থেকে বের হলে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের মতো বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ও পুলিশ দখলে নিতে পারে- এ আশঙ্কায় তিনি কোথায়ও যাচ্ছেন না।’



মন্তব্য চালু নেই