বার্ন ইউনিটের আর্তনাদ থামছেই না

‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও, জ্বলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচাও। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রোগীদের এমন ভয়ানক আর্তনাদ যেন থামছেই না। রাজনীতির আগুনে পুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তারা কাতরাচ্ছে বার্ন ইউনিটে।

এ সব অগ্নিদগ্ধরা কেউ দিনমজুর, কেউ বাস বা ট্রাকের চালক কিংবা হেলপার, কেউ এনজিওকর্মী, কেউ পোশাককর্মী, কেউ শিক্ষার্থী অথবা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। আছে নারী ও শিশু। তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না। অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাস্তায় বের হয়ে এখন ঠিকানা হয়েছে বার্ন ইউনিটে।

সম্প্রতি অবরোধ ও হরতালে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমা ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছে এ সব সাধারণ মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছে ৭৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৫ জন। এখন ভর্তি আছে ৫৩ জন রোগী।

এ সব রোগীর মধ্যে শুধু শুক্রবার রাতেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় ২৯ জন দগ্ধ হয়। এদের সবার ঠিকানা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটে।

বার্ন ইউনিটে শনিবার বিকেলে কথা হয় রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে। তারা জানালেন ক্ষোভের কথা, রাজনীতি নিয়ে বিতৃষ্ণার কথা। স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা বলতেও ভুললেন না।

বার্ন ইউনিটে কথা হয় যাত্রাবাড়ীতে অগ্নিদগ্ধ নূর আলমের স্ত্রী চম্পা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, নূরুল আলমের শরীরের ৪৮ ভাগ পুড়ে গেছে। কোনো কথা বলতে পারছেন না।

চম্পা বেগম কথা বলতে বলতে আবেগী হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। স্বামী রাজউকের ঠিকাদার। হাজারো স্বপ্ন ছিল দু’জনের। এখন স্বামী কথা বলতে পারছে না। সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার বলেছে, শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এখন স্বপ্ন একটাই আল্লাহ যেন স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখে।’

কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় থামলেন। অঝরে কাঁদলেনও। এরপর বলা শুরু করলেন রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভের কথা। তিনি বলেন, ‘আমারতো স্বামী ছাড়া কেউ নাই। ওই হাসিনা-খালেদার জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার স্বামীর কী অপরাধ?’

পাশের বেডে শুয়ে আছেন যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ আব্দুল হক। তার পাঁচ বছরের ছেলে আরাফাত হক এখন আর বাবাকে চিনতে পারছে না। পুরো মুখ দগ্ধ হওয়ায় বাবার চেহারাই বদলে গেছে। সে বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর বাবাও কথা বলতে পারে না। শুধু চোখের পানি ফেলছেন অঝরে।

আব্দুল হকের স্ত্রী রীমা বেগম জানান, স্বামী কাঁচপুরে একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ শেষে বরাব এলাকার বাসায় ফিরছিলেন। পথেই এই দুর্ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। রাজনীতির আগেও নাই, পিছেও নাই। তবে কেন রাজনীতির আগুনে পুড়ল আমার স্বামী।’

বার্ন ইউনিটের বিছানায় অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ। তিনিও শুক্রবার যাত্রাবাড়ীতে অগ্নিদগ্ধ হন। তিনি অসহ্য যন্ত্রণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এত যন্ত্রণা বলে বুঝাতে পারব না। মনে হয় আমি হয়ত আর সুস্থ হব না। আমার সব স্বপ্ন শেষ।’

দরিদ্র পরিবার থেকে নিত্য সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি জীবনযুদ্ধে হেরে গেলাম। এখন পঙ্গু হয়ে হয়ত সারা জীবন কাটাতে হবে।’

তিনি বলে চলেন, ‘কাঁচপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে পড়ালেখা চালাচ্ছিলাম। বাবা বিজি প্রেসে সামান্য বেতনে চাকরি করেন। তাই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে অনেক কষ্ট করেছি। যারা রাজনীতি করে তারা কী আমার এই কষ্টের কথা বুঝে?’ এই কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

ডিসেম্বরে সরকারবিরোধী জোটের ডাকা হরতালে অগ্নিদগ্ধ হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিমুল হক অয়ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার অসহ্য যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন তারই সহপাঠী বন্ধু হামজা রহমান অন্তর।

অন্তর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘৬ তলায় লিফটের দরজা থেকে কেবিনের ব্যবধান ২০ গজের বেশী। আজ ওর কাছে যাওয়ার সময় এই ২০ গজ দূরত্বে কেবিনের বন্ধ দরজা ভেদ করে আমার বন্ধু অয়নের চিৎকার ভেসে আসছিল আমাদের কানে। একটা মানুষকে জবাই করলে সে যেভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার করে কাতরায়, ঠিক সেভাবে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল অয়ন।’

‘জানি না সাত আসমানের উপর যিনি বসে আছেন তার কাছে এই আওয়াজ পৌঁছায় কিনা। আমি নিশ্চিত নই। বিনা দোষে তারই হাতেগড়া সৃষ্টির এত করুণ হৃদয়বিদারক পরিণতি কীভাবে তিনি সহ্য করেন? তিনি সব কিছুর মালিক। তিনিই সব ভাল জানেন।’

‘হে আল্লাহ, হে পরওয়ারদিগার, আমার অন্তর্যামী, তোমার সাত আসমান কত দূরে, কত বড় আমি তা জানি না। তোমার সৃষ্টির রহস্য কত গভীর তাও আমি জানি না। শুধু জানি আমার বন্ধু অয়নকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমার বন্ধুকে মুক্তি দাও খোদা, কৃপা কর। আমার বন্ধু অয়ন যদি কোনো পাপ করে থাকে তা আমাকে দিয়ে দাও এবং আমি যদি কোনো কালে কোনো পুণ্য করে থাকি তার বিনিময়ে হলেও আমার বন্ধুকে তুমি মুক্তি দাও। ওর এই আর্তনাদ আর সইছে না খোদা!’

গত ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি জোটের ডাকা হরতালের আগের দিন মিরপুরে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিমুল হক অয়ন অগ্নিদগ্ধ হন। তার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে যায়। ওই ঘটনায় তার মা শামসুন্নাহার ও বোন আনিকাও অগ্নিদগ্ধ হয়। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই