কফিন ব্যবসা

সন্ত্রাসী হামলায় কফিন ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো

কফিন ব্যবসা। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলটিতে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা জঙ্গি বিদ্রোহে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দারা। তবে এইসব দুঃখজনক হামলায় তাদের অর্থনীতির একটি দিক কিন্তু ফুলে ফেপে ওঠেছে- সেটি হল কফিন ব্যবসা।

ইসলামি রীতিতে মৃতদের দাফনের জন্য কফিনের প্রয়োজন পড়ে না।পাকিস্তানে সাধারণত: দড়ি দিয়ে তৈরি বিছানার ওপর মুর্দাদের রেখে কবর দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বন্দুক বা আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং আইইডি হামলায় যখন মৃতদেহগুলো বীভৎসভাবে ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায়, তখন তাদের কবর দেয়ার জন্য কফিন ছাড়া গতান্তর থাকেনা।

পেশোয়ারে কফিন ব্যবসার পথিকৃৎ হলেন ৬০ বছরের জেহানজেব খান। তিনি এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন ৮০ দশকের গোড়ার দিকে। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন,‘যখন ব্যবসা শুরু করি তখন দিনে ২/৩টা কফিন বিক্রি করতাম।’

তখন তার বেশিরভাগ গ্রাহকই ছিলেন আফগান উদ্বাস্তুরা। সোভিয়েত বাহিনীর আফগানিস্তান দখলের কারণে তারা পাকিস্থানে এসে ঠাঁই নিয়েছিল। ফলে এসব উদ্বাস্তুদের কেউ মারা গেলে তাদের মৃতদেহ দেশে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কফিনের প্রয়োজন হত। কিন্তু ২০০৪ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা শুরুর পর জেহানজেব খানের কফিন ব্যবসা লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। কেননা তখন পাকিস্তানের উপজাতি এলাকাগুলোতে এসে জঙ্গিরা আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে মৃতের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করে।

পাকিস্তান সরকারের দেয়া তথ্যানুযায়ী দেশটিতে গত এক দশকে বন্দুক, বোমা এবং আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব মরদেহ সৎকারের জন্য কফিনের চাহিদা পূরন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন পেশোয়ারের কফিন ব্যবসায়ীরা।

জেহানজেব খান বলেন,‘বোমা বিস্ফোরণে মৃতদের লাশ দাফনের জন্য কফিনের চল শুরু হলেও এখন বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের দাফনের জন্যও অনেকে কফিন ব্যবহার করছেন।’

তাই তো খানের ব্যবসা এখন রমরমা। কফিন ব্যবসার এই সুদিনের কারণে ৪৫ লাখ লোকসংখ্যার এই শহরটিতে কফিন ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ফলে জেহানজেব খানকে এখন আরো ৪০ জনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তিনি প্রতিদিন গড়ে ১৫টি করে কফিন বিক্রি করে থাকেন।

তবে সন্ত্রাসী হামলার কথা চিন্তা করে সবসময় আগাম ৮০টি কফিন মজুদ করে রাখেন খান। পাকিস্তানে কখন সন্ত্রাসী হামলা হয় কে জানে?গত মাসেই তো পেশোয়ারের আর্মি স্কুলে তালেবান হামলায় দেড়শ জন নিহত হয়েছিল। ওই হামলার পর খানকে অতিরিক্ত ৬০টি কফিন তৈরি করতে হয়েছিল।

পেশোয়ারের আরেক কফিন ব্যবসায়ী শেহরিয়ার খান। ২৩ বছরের এই তরুণ সাধারণত সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্যই কফিন তৈরি করে থাকেন।সেনাদের জন্য ভালো কাঠ দিয়ে কফিন তৈরি করতে হয়। এ কারণে এর দামও বেশি হয়ে থাকে। যেখানে ৩০ ডলার দিয়েই সাধারণ মানের একটি কফিন পাওয়া যায়, সেখানে সেনাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কফিনের দাম পড়ে ১শ ডলার। তবে এসব কফিনের চাহিদা তেমন বেশি নয়। সামরিক বাহিনীর কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মারা গেলেই কেবল ওই কফিনের অর্ডার আসে। দামি কাঠ, ভালো মানের ফোম এবং মখমলের কাপড় দিয়ে তৈরি হয় এইসব কফিন। ফলে এগুলোর কোনো কোনোটির দাম ৩৫ হাজার পাকিস্তানি রুপি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ইসলামিক রীতি অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব মৃতের দাফন করা জরুরি। কেউ মারা গেলে সাধারণত: সূর‌্যাস্তের আগেই মৃতদেহ দাফন করার নিয়ম রয়েছে।এ কারণে শেহরিয়ার খানের দোকানে ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলে। তার দোকানের কর্মচারী নিয়াজ আলী সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমি রাতে দোকানেই ঘুমাই। অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও এটি জানেন। তাই কফিনের প্রয়োজন হলেই তারা আমাদের দোকানে ছুটে আসেন।’

তবে এ ব্যবসায় লাভ আসলেও এটি যে অন্যদের জন্য দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি নির্ধিদ্বায় স্বীকার করলেন জেহানজেব খান । সম্প্রতি পেশোয়ার স্কুলে সংগঠিত তালেবান হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘এর আগের অন্যান্য হামলার ঘটনায় আমি ব্যথিত হয়েছি। তবে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক। ওরা আমাদের শিশুদের কেড়ে নিয়েছে।’

পাকিস্তানের একটি ইসলামিক দাতব্য সংস্থা হচ্ছে ‘আল খিদমত’। এরা সন্ত্রাসী হামলায় নিহত দরিদ্র এবং অজ্ঞাতনামাদের জন্য বিনামূল্যে কফিন সরবরাহ করে থাকে। সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট খালিদ ওয়াকাস কফিন ব্যবসার সম্পর্কে বলেন,‘শহরে বড় কোনো সন্ত্রাসী হামলার খবর শুনলেই ব্যবসায়ীরা কফিনের দাম বাড়িয়ে দেয়। এভাবে কিছু লোক মানুষের চরম বিপর্যয়কে পুঁজি করে অন্যায়ভাবে মুনাফা লুটে নিচ্ছে।’

সূত্রঃ গালফ নিউজ



মন্তব্য চালু নেই