যেভাবে হত্যা করা হয় মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে

মিশরেরর প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করা হয়েছিল ৩৫ বছর আগে ১৯৮১ সালে। ইসরায়েলের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তি সই করার পর আরব বিশ্বজুড়ে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিবাদ। ‘ইতিহাসের সাক্ষী’তে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী জেহান সাদাত।

১৯৮১ সালের ৬ই অক্টোবর। আট বছর আগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মিশরের সর্বশেষ যুদ্ধের বার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে কায়রোতে। সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের জন্য উপস্থিত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। আনোয়ার সাদাতের স্ত্রী জেহান সাদাত সেদিনটির কথা স্পষ্ট মনে করতে পারেন।

“সেদিনটা ছিল ওর কাছে খুবই প্রিয় একটা দিন। এই দিনটিকে নিয়ে ও গর্ব করতো। আমি সেদিন ওকে বুলেট প্রুফ বর্ম পড়তে বললাম। কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না। ও বললো, বুলেট তো আমার মাথায়ও লাগতে পারে। তাহলে কি আমাকে মাথায়ও কিছু পরতে হবে? নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ওর যেন কোন মাথাব্যাথাই ছিল না। কোন কিছু না পরেই সে চলে গেল।”

আনোয়ার সাদাত যেদিন ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেদিন থেকেই স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে উৎকন্ঠা তৈরি হয় জেহান সাদাতের মধ্যে। তার মনে হচ্ছিল, আনোয়ার সাদাতকে মেরে ফেলা হবে।

সামরিক কুচকাওয়াজের এক পর্যায়ে আকাশে চলছিল বিমান বাহিনীর মহড়া। সবার দৃষ্টি যখন সেদিকে, তখন মঞ্চের কাছে বিস্ফোরিত হলো দুটি গ্রেনেড। দুটি সামরিক যান থেকে একদল সৈনিক লাফ দিয়ে নামলো। কালাশনিকভ অটোমেটিক রাইফেল থেকে গুলি করতে করতে তারা প্রেসিডেন্টের দিকে দৌড়ে গেল।

“আমার দেহরক্ষী আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কারণ জানালা দিয়ে গুলি আসছিল। ও আসলে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল।”

আনোয়ার সাদাতকে শেষ বার তিনি দেখেছিলেন, যখন কুচকাওয়াজের জবাব দেয়ার জন্য তিনি উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন তখন। আনোয়ার সাদাত ভেবেছিলেন, সৈন্যরা তাঁকে স্যালুট জানাতে আসছে। কিন্তু পরে ও বুঝতে পারলেন ওরা তাকে হত্যা করতে আসছে।

আনোয়ার সাদাত যখন মারা যান, তখন তার বয়স ৬২। আর জেহান সাদাতের বয়স ৪৬। জেহান তার ১৫তম জন্মদিনে প্রথম আনোয়ার সাদাতকে দেখেন। আনোয়ার সাদাত তখন মিশরের সেনাবাহিনীর এক তরুণ অফিসার। সহকর্মী বন্ধু গামাল আবদেল নাসেরের মতো তিনিও জাতীয়বাদে বিশ্বাসী। মিশরের ওপর ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ছেন তারা।

১৯৫২ সালে মিশরের যে সেনা অফিসাররা মিলে নাসেরের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ব্রিটিশদের তাড়ায়, তাদের সঙ্গে ছিলেন আনোয়ার সাদাতও। তবে এসব ঘটনা তাদের প্রথম সাক্ষাতের কয়েক বছর পরের ঘটনা। সাদাত তখন ব্রিটিশ বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছেন। জেহানের জন্মদিনে তাদের দেখা হলো এক বাড়িতে।

“জেল থেকে বেরিয়ে ও সোজা চলে এসেছিল এক চাচাতো বোনের স্বামীর বাসায়। ওরা ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেখানেই ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। ও সেখানে আমার ১৫ তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়। ও আমাকে বলছিল, আমার কাছে কোন টাকা নেই, কোন দেয়ার মতো উপহার নেই, আমি শুধু তোমাকে একটা গান শোনাতে পারি। একথা বলে ও গান গাইতে শুরু করলো।”

আনোয়ার সাদাত এবং জেহানের বিয়ে হয় ১৯৪৯ সালে। এর ২১ বছর পর ১৯৭০ সালে মারা যান মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের। তিনি ছিলেন সাদাতের বন্ধু এবং রাজনৈতিক গুরু। নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাতই হলেন মিশরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।

মিশর তখনো ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে লজ্জাজনক হার সামলে উঠতে পারেনি। ঐ যুদ্ধে মিশর গাজা এবং সিনাই অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে আনোয়ার সাদাত আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধে মিশর জিততে পারেনি সত্য, তবে এতে তাদের পরাজয়ও হয়নি।

এই যুদ্ধের পর আনোয়ার সাদাতের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। কিন্তু এর চার বছর পর ১৯৭৭ সালে আনোয়ার সাদাত এমন এক কাজ করলেন, যা কোনদিন সম্ভব বলে কেউ ভাবেনি। আনোয়ার সাদাত শুধু ইসরায়েলকেই স্বীকৃতি দিলেন না, তিনি ঘোষণা করলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার জন্য তিনি জেরুসালেমে যাবেন।

“ও যখন পার্লামেন্টে এই ঘোষণা দেয় তখন আমি বাসায় ছিলাম না। যখন বাসায় ফিরলাম, দেখি আমার ছোট মেয়ে আমার জন্য বসে আছে। আমার মেয়ে বললো, মা, মা, তুমি কি শুনেছ বাবা কি বলেছে । আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি উপরে গেলাম। দেখি ও বসে আছে খুবই শান্ত ভঙ্গীতে। আমি বললাম, আনোয়ার, তুমি কি বুঝতে পারছে, তুমি সব আরব নেতার সমর্থন হারাবে? ও বললো, হ্যাঁ আমি জানি। ও জানতো যে এই সিদ্ধান্ত খুবই বিপদজনক। ও জানতো, এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত, এবং এটা পুরো আরব বিশ্বের মানুষকে একটা বড় ধাক্কা দেবে। কিন্তু ওর ধারণা ছিল, একটা সময়ে গিয়ে মানুষ বুঝতে পারবে, ও কি করেছে। ও চাইছিল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে।”

আনোয়ার সাদাতের এই সিদ্ধান্তের পর পরই বিক্ষোভ শুরু হলো। “আমাদের চারপাশের সবাই, সব বন্ধু-বান্ধব, সবাই তাকে বললেন, আপনি এই কাজ করবেন না। এটা বিপদ জনক। অনেক সাংঘাতিক ঝুঁকি এই কাজে। আপনি আপনার জীবন হারাতে পারেন। কিন্তু ও একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এই কাজ ও করবেই।”

১৯৭৭ সালের নভেম্বরে আনোয়ার সাদাত ইসরায়েল সফরে গেলেন। “ইসরায়েল রওনা হওয়ার আগে আমরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলাম। আমরা একসঙ্গে অনেক ছবি তুললাম। আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা যেন শেষবারের মতো একসঙ্গে ছবি তুলছি।”

“যখন ওকে নিয়ে হেলিকপ্টার আকাশে উড়াল দিল, আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম। আমি, আমার ছেলে-মেয়ে, আমরা সবাই কাঁদছিলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল, ওকে আমরা আর ফিরে পাব না।”

কিন্তু আনোয়ার সাদাত ফিরে এলেন। এর ১৮ মাস পর ১৯৭৯ সালের মার্চে মিশরের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তিতে সই করলেন তিনি। তিনি হলেন প্রথম আরব নেতা, যিনি ইসরায়েলের সঙ্গে এরকম কোন চুক্তি করলেন।

প্রেসিডেন্ট সাদাত এবং ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট মোনাকেম বেগিনকে সেবছর এই কাজের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু আনোয়ার সাদাতের জীবন নিয়ে শংকা কমছিল না।

“প্রতিটা সময়, প্রতিটা দিন, প্রতিটা মিনিট যখন ও বাইরে যেত, কোন কাজে, কোন সভায়, আমার মনে হতো, ও বোধহয় আর ফিরে আসবে না।” মৃত্যুর একমাস আগে আনোয়ার সাদাত নিজেই অবশ্য এরকম একটা আশংকার ইঙ্গিত দিলেন।

“একদিন আমরা হাঁটছিলাম, তখন ও আমাকে বলছিল, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমার মনে হচ্ছে আমি আল্লাহর দেখা পাব। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। কারণ আমার স্বামী কোনদিন এভাবে মৃত্যুর কথা বলেনি। আমি তাকে বললাম, আনোয়ার, কখন তুমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, সেটা তো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ও জবাব দিল, আমি জানি জেহান, আমি জানি।”

ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলের কাছ থেকে মিশরের সিনাই উপত্যাকা ফেরত পেলেন। কিন্তু এজন্যে যে তাকে ইসরায়েলের সঙ্গে করমর্দন করতে হলো, সেটাকে মিশরের অনেক মানুষই মেনে নিতে পারছিল না। তারা মনে করছিল, সিনাই ফেরত পেতে আনোয়ার সাদাত অনেক চড়া মূল্য দিয়েছেন। মিশরে অস্থিরতা দেখা দিল। সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হলো। আনোয়ার সাদাত তার শত শত বিরোধীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন।

১৯৮১ সালের ৬ই অক্টোবর। সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের সময় একটা ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নামলো চারজন সেনা অফিসার। প্রেসিডেন্টের দিকে তারা গুলি চালালো, গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলো। হামলায় গুরুতর আহত প্রেসিডেন্ট সাদাতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।

“আমি হাসপাতালে গেলাম। বহু মানুষে হাসপাতাল ভর্তি। আমি হাসপাতালের উপরের তলায় গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কেন? আপনি কেন আমার স্বামীর পাশে থাকছেন না। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। আমি তখন বুঝে ফেললাম কী ঘটেছে।”

“আমার জন্য সেটা ছিল খুবই কঠিন একটা দিন। যাকে আমি সারাজীবন ভালোবেসেছি, শুধু সেই স্বামীকে হারিয়েছি বলে নয়। ও শুধু আমার স্বামী ছিল না, ও ছিল আমার সঙ্গী। সেদিন আমার অর্ধেক যেন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর আমি কিভাবে এই পৃথিবীতে বাঁচবো, আমি বুঝতে পারছিলাম না।” বিবিসি



মন্তব্য চালু নেই