বিজয় দিবস অনুষ্ঠান উদ্বোধন মমতার, তিস্তা নিয়ে সবাই চুপ!
বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস গত বছর থেকে এই শহরে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছে। এবারও সেটা সাড়ম্বরে হবে, এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। নতুন হলো- পাঁচ দিনব্যাপী এ বছরের উৎসবের সূচনা বৃহস্পতিবার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর উপস্থিতিতে। কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-দূতাবাসের উপ-রাষ্ট্রদূত জকি আহাদ বলেন, ‘এই উৎসব নতুন মাত্রা পেল ও প্রাণবন্ত হলো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমনে।’
এমন একটা সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মহান বিজয় দিবস উৎসবের উদ্বোধন করলেন, যখন বাংলাদেশ প্রবলভাবে চাইছে তিস্তার পানি চুক্তি অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হোক, কিন্তু সেটা হতে পারছে না প্রধানত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে। কেন্দ্রের মোদী সরকার তথা বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের মমতা সরকার তথা তৃণমূলের সংঘাত এখন চরমে, মূলত নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। মমতা বিলক্ষণ জানেন, তিস্তার পানি চুক্তি করা গেলে মোদী সরকারের কূটনৈতিক লাভ। সেই ফায়দা কেন্দ্রকে কিছুতেই মমতা তুলতে দেবেন না, যতক্ষণ না তিনি তাঁর বিনিময়ে নিজের কোনও ফায়দা তুলতে পারছেন। সেই সঙ্গে এ মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের কথা থাকলেও সেটা পিছিয়ে গিয়েছে।
আবার মমতা বোঝেন, পড়শি রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরাগভাজন হলে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা। সেই জন্য আজকের এই অনুষ্ঠানে মমতা তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ আয়ু ও সুস্থ জীবন কামনা করেছেন। মমতা বলেছেন, দুই বাংলার মানুষ এক, মাটি এক, সংস্কৃতি এক— কেবল দু’টো দেশের সীমান্তই যা রয়েছে। মমতা আর একটা কথা এ দিন বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘দুই বাংলার কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক চিরকাল অটুট থাকবে।’
সাংবাদিক হিসেবে অসংখ্যবার বাংলাদেশ যাওয়ার সুবাদে দেখেছি, সে দেশের মানুষ যেমন অতিথিবৎসল, তেমনই কিন্তু স্পর্শকাতর। দু’টো ঘটনার কথা মনে আছে।
একবার নীরদ সি চৌধুরী কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় তাঁর নিবন্ধে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। তার পর বেশ কিছুকাল ওই পত্রিকার প্রবেশ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার কলকাতার অন্য একটি পত্রিকায় জাদুকর পিসি সরকার (জুনিয়র) লেখেন, বাংলাদেশের মানুষ খাওয়ানোর নামে এতোই অত্যাচার করেন যে, তাঁকে এক দাওয়াতের পর অন্য দাওয়াতে যাওয়ার মাঝখানে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পেট খালি করতে হয়। জাদুকর আমার পরিচিত জেনে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসে বহু মানুষ তখন আমার কাছে ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ‘সমস্যা থাকলে উনি দাওয়াত নেবেন না, অযথা দোষারোপ করছেন কেন!’
আসলে বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু খুব সহজে, খুব অল্প সময়ে যে কোনও মানুষকে আপন করে নিতে পারেন সেই জন্যই তাঁদের হৃদয় অল্প আঘাতেই ক্ষতবিক্ষত হয়, সেখান থেকে রক্ত ঝরে। তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে একরাশ অভিমান জমা হয়ে আছে, সেটা মমতা সম্ভবত উপলব্ধি করেছেন।
নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতা বলেছেন, ‘আজ হৃদয়ের সমস্ত মাধুরী দিয়ে আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি।’ একই সঙ্গে মমতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রচেষ্টাতেই ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ড বাউন্ডারির কাজ সম্পন্ন হয়েছে, দুই দেশ তথা দুই বাংলার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আদান-প্রদান যাতে আগামী দিনে আরও বাড়ে, সে দিকেও জোর দিতে বলেছেন মমতা।
এই পারস্পরিক আদান-প্রদান এক ঝটকায় অনেকটা বাড়তে পারে ও সৌহার্দ্য অন্য মাত্রায় পৌঁছতে পারে তিস্তা পানি চুক্তি সম্পাদন হলে- বাংলাদেশ এমনটাই মনে করে। আবার বাংলাদেশও জানে, মমতাকে টপকে শুধু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলে তার জোরে যদি কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করে, সে ক্ষেত্রে সেটা হিতে বিপরীত হবে।
সেই জন্যই বৃহস্পতিবারের এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর একটি কথা তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেই। আমুর কথায়, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে।’ আবার আমুর নিশ্চয়ই মাথায় ছিল, এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিস্তা প্রসঙ্গ সরাসরি উত্থাপন করতে যাওয়া সমস্যার। তাই তিনি বলেছেন, ‘বাকি যা সমস্যা আছে, তা আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা হয়ে যাবে বলে আমরা আশা রাখি।’
বাকি সমস্যাগুলির মধ্যে প্রথম ও প্রধানই তো হল, তিস্তার পানি আটকে থাকা! -বাংলা ট্রিবিউন।
মন্তব্য চালু নেই