৬৮ বছরের গ্লানি কাটিয়ে ওরা এখন নিজের পরিচয়ে স্কুলে যায়

৩১ জুলাই। গত বছরের এই দিন বাস্তবায়ন হয় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বহুল আলোচিত স্থল সীমান্ত চুক্তি। এই দিন মধ্যরাতে উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় ঘোষণার পর ৬৮ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয় ছিটমহলের বাসিন্দারা।

বাংলাদেশ ঘোষণার পর যুগের পর যুগ অবহেলিত এসব জনপদ এবং বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করে সরকার। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, পুস্পস্তবক অর্পণ, শিশুদের খেলাধুলাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

জেলা প্রশাসন ও বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহল সূত্রে জানা গেছে, একটি দেশের নাগরিকত্বের অভাবে দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে অবহেলিত ছিল পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, বোদা এবং সদর উপজেলার বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের বাসিন্দারা। এক বছর আগে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তারা বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হয়েছেন।

জেলার ৩৬ ছিটমহলের মধ্যে ১৭ ছিটমহলে জনবসতি রয়েছে। প্রায় ২০ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার (সদ্য তালিকাভূক্ত)। এসব এলাকায় ১০৫ দশমিক ২৫ কি.মি সড়ক এবং ১৯৩ মিটার ব্রিজ-কালভাট, ১০ দশমিক ৫ কি.মি. খাল খনন, ১১টি বাজার সেট, ৭টি মসজিদ এবং ৫টি মন্দির নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এর মাধ্যমে এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা। আগামী তিন বছরের মধ্যে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া ২২৬ কি.মি. বিদ্যুত সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ৮ হাজার ৫০৪ জন গ্রাহককে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে একটি ক্লিনিকে ইতোমধ্যে সেবাদান শুরু করা হয়েছে।

প্রায় আড়াই হাজার হাস-মুরগির টিকাদানসহ ৫০টি গবাদি পশু বিতরণ করা হয়েছে। এক হাজার ১০৯ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৪৭৪ জনকে বিধবা ভাতা এবং ২৭৪ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করা হয়েছে।

তিন উপজেলায় ৫টি বিদ্যালয়ের অনুমোদন হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের ভবন উন্নয়নের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৪২টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচন (বিআরডিবি) এর পক্ষ থেকে ১৫টি সমিতি করা হয়েছে। এছাড়া বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল সার্ভের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দৃশ্যমান এসব উন্নয়নে বেশ খুশি বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। বিশেষ করে তাদের শিশুরা এখন নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছে। এর আগে এসব এলাকার বাসিন্দারা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের পরিচয় ব্যবহার করে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতো।

গারাতি ছিটমহলের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলিম মাদরাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোমা আকতার ও সাকিল হোসেন বলেন, আগে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের স্কুল ও মাদরাসায় লেখাপড়া করতে হতো। এখন আমার নিজেদের ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করছি। এটাই আমাদের বড় পাওয়া।

একই ছিটমহলের কৃষক জয়নদ্দিন বলেন, আমাদের পাশে অনেক বাংলাদেশি এখনো বিদ্যুত পায়নি। আমরা নতুন বাংলাদেশি হিসেবে এক বছরের মধ্যে বিদ্যুতের আলো পেয়েছি। এখন আমরা আলোকিত বাংলাদেশি।

গারাতি ছিটমহলের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, ৩১ জুলাই আমাদের জন্য গৌরবের দিন। এই দিনে আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি। ৬৮ বছরের বন্দি জীবন থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আমরা এখন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক।

ইতোমধ্যে আমরা সরকারিভাবে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, বিদ্যুত সংযোগসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়েছি। আজকের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে আমরা, মধ্যরাতে পুস্পস্তবক অর্পণ, ১ আগস্ট সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং দিনভর শিশুদের নিয়ে খেলাধুলাসহ নানান আয়োজন করেছি।

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ গোলাম আজম বলেন, পঞ্চগড়ের তিন উপজেলার বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলে রাস্তাঘাট ও ব্রিজ-কালভাট উন্নয়নে এলজিইডি কর্তৃক ৮২ দশমিক ৬৬ কোটি এবং জেলা পরিষদ ১৬২ কোটি টাকার ২৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

বর্ষার পর সড়ক, ব্রিজ-কালভাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন উন্নয়ন কাজ শুরু হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের ফলে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেছে।



মন্তব্য চালু নেই