জীবনীতে প্রকাশ পেল সু চি’র মুসলিম বিদ্বেষ
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞে শান্তিতে নোবেলজয়ী গণতন্ত্রপন্থি নেত্রীর অং সান সু চি’র নীরবতার ব্যাখ্যা বোধহয় পাওয়া গেল। শান্তিতে নোবেল পেলেও মিয়ানমারের অন্য দশটা নাগরিকের মতো তিনিও অন্তরে মুসলিম বিদ্বেষ পোষণ করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত সু চির একটি জীবনীগ্রন্থে এমন বোমা ফাটানো তথ্যই প্রকাশ পেয়েছে।
জীবনীটি লিখেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক পিটার পোফাম। “The Lady and the Generals: Aung San Suu Kyi and Burma’s Struggle for Freedom” শীর্ষক বইয়ে তিনি সু চি’র নানা দিকের সাথে এই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিজাত সংস্কারটিও তুলে ধরতে ছাড়েননি।
সারা বিশ্বই সু চিকে একজন ধৈর্যশীল এবং গণতন্ত্রের জন্য একনাগারে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাওয়া এক আদর্শ নারী বলেই জানে। এই ধৈর্যের ফলই তিনি পেতে যাচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে তার দল বসতে যাচ্ছে ক্ষমতার মসনদে। এই শান্ত সৌম্য নেত্রীর চরিত্রে যেন কলঙ্ক লেপন করে দিল নতুন বইটিতে প্রকাশিত তথ্যটি।
বইয়ের একটি স্থানে বলা হয়েছে, বিবিসি টুডে প্রোগ্রামের উপস্থাপিকা মিশাল হুসেইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হঠাৎ করে ক্ষেপে যান সু চি। এতোটাই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন যে অফএয়ারে বলে ফেলেন, ‘আমাকে কেউ বলেনি যে একজন মুসলিম আমার সাক্ষাৎকার নেবে!’
মিয়ানমারের ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসির সভাপতি সু চির বয়স এখন সত্তর। বছর দুয়েক আগে সরকারি মদদে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞ এবং নিজ দেশের মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের সমালোচনার না করার ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করেন ওই উপস্থাপিকা। কিন্তু বরাবরই তিনি এর নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেন। প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় নানা কারণে আরো অনেক অনেক বৌদ্ধ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আমাদের নিষ্পেষিত হওয়ার এটি একটি ফল।’ এই বলে দায় সারা পর অফএয়ারে তিনি ওই সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, মিশাল হুসেইন রেডিও ৪ এর প্রথম কোনো মুসলিম উপস্থাপক। তিনি সু চির সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ২০১৩ সালে। এই সময়টাতে মিয়ানমারে মুসলিম বিদ্বেষ তুঙ্গে ওঠে এবং বহুহতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ বিষয়ে সু চির নীরবতা আন্তর্জাতিক মহলকে স্তম্ভিত করেছিল।
এছাড়া ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল যে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলো তাতে দলের পক্ষ থেকে একজনও মুসলিম প্রার্থী ছিলেন না আর সু চির সরকারে কোনো মুসলিম মন্ত্রীও থাকছে না। অথচ সংখ্যালঘু মুসলিমদের একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালে মিয়ানমারে সামরিক সরকারের মদদে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়। এসময় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা হতাহত হয় এবং কয়েক লাখ পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, কেউ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যেতে গিয়ে মাঝ সাগরে ডুবে মারা গেছে। মিয়ানমারে এখনো ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মানবেতর জীবনযাপন করছে। কিন্তু এদের বিষয়ে সু চি একটি শব্দও খরচ করেননি কখনো।
সু চি তার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য বিশ্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধার্হ। সম্মান দিয়ে তাতে বলা হয় ‘দ্য লেডি’। কিন্তু ব্যক্তিগত সংস্কার এবং রাজনৈতিক ইচ্ছেপূরণের মানসিকতার মধ্যে যে একটা অন্ধকার অঞ্চল আছে সেটিই তুলে এনেছেন জীবনীকার পিটার পোফাম।
এ ব্যাপারে লেখক বলেন, আমি মনে করেছি, এই বিষয়টাও বইয়ে আনা দরকার। কারণ, এই ইস্যুতে তার (সু চি) অবস্থানগত অস্পষ্টতা প্রকাশ করে।
তিনি বলেন, একজন তার জীবনের গল্প এবং সাহসিকতার কারণে প্রশংসার্হ হতে পারে কিন্তু এখন থেকে আর কেউ বিশ্বাস করবে না যে, তিনি এমন এক ব্যক্তি যার মধ্যে কোনো ভুল নেই এবং নেই কোনো সংস্কার এবং সীমাবদ্ধতা।
তবে মুসলিমদের ব্যাপারে সু চির কোনো সংস্কার আছে বলে বিশ্বাস করেন না লেখক। কারণটা তার জীবনীতেই খুঁজে পাওয়া যায়। সু চি প্রথম যে যুবকটির সাথে সিরিয়াস সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি একজন পাকিস্তানি মুসলিম। এছাড়া ১৯৮৮ সালে যে লোকটি তাকে রাজনীতিতে আসতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি একজন বার্মিজ মুসলিম বুদ্ধিজীবী।
লেখকের বিশ্বাস, যে দেশটিতে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়াবাড়ি রকমে প্রভাবশালী সেখানে আগে নিজের ক্ষমতা সুসংহত রাখতে তাকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেই আপাতত স্থির থাকতে হচ্ছে।
তবে মিয়ানমারের মুসলিমরা কিন্তু সু চিকে নিয়ে অতোটা ইতিবাচক ভাবনা ভাবছেন না। গত নির্বাচনে একচেটিয়া ভোট পেলেও ভবিষ্যতে তার দল সেটা ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সু চির উপর থেকে তাদের আস্থা ক্রমেই উঠে যাচ্ছে, আশাভঙ্গের গ্লানিতে ভুগছেন তারা। তাদের মধ্যে বাড়ছে শঙ্কা। একজন মুসলিমের বক্তব্যের সেটা খুব স্পষ্ট, তিনি বলেন, আমরা এখনো এনএলডিকে (সু চির দল) ভোট দিবে। তবে ব্যালটে সিলটা মারা সময় আমরা নাক চেপে ধরেই মারবো!
তথ্যসূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ
মন্তব্য চালু নেই