বাংলাদেশের সমস্যা রাষ্ট্রধর্ম নয়, মানসিকতা…
বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রধর্ম থাকা উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরেই৷ কেউ কেউ মনে করছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মূল কারণ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম৷ সত্যিই কি তাই?
স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ যোগ করা হয়৷ সে বছরই সংবিধানের এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়৷ সেই রিটের সুরাহা এখনো হয়নি৷ তবে শীঘ্রই হয়ত আদালত এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত জানাবেন৷
তবে আমার লেখার মূল বিষয় সেই রিট নয়৷ ২৭ বছর আগে করা রিটের আইনজীবী অ্যাডভোকেট একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিকের একটি মন্তব্য আমাকে বেশি ভাবিয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে গত তিন মার্চ তিনি জানিয়েছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মূল কারণ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম৷
প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছেন?
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই৷ দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু৷ বাকি ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু, যাদের মধ্যে ১৪ দশমিক দুই শতাংশ মুসলমান৷ রাষ্ট্রধর্মহীন দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা গতবছর আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৭ শতাংশ৷ সরকারি হিসেবে, ২০১৫ সালে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার ৭৫১টি ঘটনায় কমপক্ষে ৯৭ জন প্রাণ হারিয়েছে, আহত ২,২৬৪৷
গরুর মাংস খেয়েছেন, এমন সন্দেহে গতবছর সেদেশে একজন মুসলমানকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে৷ আর পুলিশ সেই হত্যাকণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে তিনি সত্যিই গরুর মাংস খেয়েছিলেন কিনা সেটা বের করাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে! সেই ঘটনার পর মাঝেমাঝেই শোনা যাচ্ছে, মুসলমান গরু ব্যবসায়ীদের হত্যার খবর৷
ভারতে এমন এক সময় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা বাড়ছে যখন দেশটিতে ক্ষমতায় আছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)৷ আর দেশটির প্রধানমন্ত্রী এখন নরেন্দ্র মোদী, গুজরাট দাঙ্গার সময় সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক৷ সেই দাঙ্গার পর দীর্ঘদিন তাঁর ইউরোপ, অ্যামেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশের মানুষ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷ যদিও এটা কারো অজানা নয় যে, ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল কমপক্ষে ১২০০ মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান৷
জার্মানিতে সংখ্যালঘুরা যা পান না
যে দেশটিতে বসে এই লেখা লিখছি, জার্মানি, সেটিরও কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই৷ তবে ক্ষমতায় থাকা দলটি রক্ষণশীল, নাম খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল (সিডিইউ)৷ দলটি সময়ের সাথে সাথে নিজেদের বদলালেও সমকামীদের বিয়েতে আজও সায় দেয়নি৷ তবে এমন ভাবার কারণ নেই, জার্মানিতে সংখ্যালঘুরা বুঝি খুব কষ্টে আছে৷ মোটেই নয়, বরং মোট জনসংখ্যার চার দশমিক দুই শতাংশ সংখ্যালঘুরা অনেক সুযোগ সুবিধাই পান৷ যা পান না তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলাতে জার্মানিতে ছুটি থাকে না, থাকে খ্রিষ্টানদের উৎসবের দিনগুলোতে৷
জার্মানির মসজিদে মাইকে আযান দেয়ার নিয়ম নেই, তবে গির্জায় নিয়মিত বিরতিতে ঘণ্টা পেটাতে বাধা নেই৷ কোরবানির পশু জবাই দেয়ার নিয়ম নেই৷ সংখ্যালঘুদের ধর্ম মেনে বিয়ে করলে, সেই বিয়ের কোনো আইনি বৈধতা নেই৷ লেখা বাহুল্য, রাষ্ট্রধর্মহীন দেশটিতে সংখ্যালঘুরা এ সব মেনে নিয়েই দিব্যি ভালো আছেন৷
বাংলাদেশ যা পেরেছে, পারেনি
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ যেমন আছে, তেমনি এটাও পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে দেশটিতে সব ধর্মের মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা সমান৷ ফলে রাষ্ট্রধর্ম থাকা না থাকাটা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার৷ এটা থাকায় সমাজের একটি ধর্মান্ধ অংশ আত্মতুষ্টিতে ভোগে, কিন্তু আইনের বিচারে সেটা তাদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয় না৷
বরং জার্মানি এবং ভারতের মতো রাষ্ট্রধর্মহীন দেশ সংখ্যালঘুদের যা দিতে পারেনি, বাংলাদেশ তার অনেকটাই পেরেছে৷ মোটের উপর, রাষ্ট্রধর্ম থাকা বাংলাদেশে কোনো ধর্মভিত্তিক দল স্বাধীনতার পর আজ অবধি এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি৷ ভবিষ্যতে পারবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই৷ তাই রাষ্ট্রধর্ম থাকার কারণে মূলত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে, এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না৷ বরং আমি মনে করি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মূল কারণ দু’টি৷
প্রথমত, রাজনৈতিক৷ সংখ্যালঘুদের বড় একটি অংশ বর্তমানে ক্ষমতায় থাক দলটির সমর্থক হিসেবে পরিচিত৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই দল ক্ষমতায় থাকলেও সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হন, না থাকলেও হন৷ গত কয়েকবছরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখতে পাওয়া যায়, একাধিক ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় সদস্যদের পরিষ্কার অংশগ্রহণ রয়েছে৷ সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করা গেলে তাদের উপর নির্যাতন কমবে বলে আমার বিশ্বাস৷
দ্বিতীয়ত, সম্পদ লুট৷ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের একটি অংশ সুযোগ পেলে সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুটে নেয়ার চেষ্টা করেন৷ এ জন্য তারা এমন একটা অবস্থা তৈরি করে, যাতে সংখ্যালঘুরা ভিটামাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন৷ যদিও বাংলাদেশের আইন এটা রোধে যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানসিকতায়৷ আইন প্রয়োগের মানসিকতায় ঘাটতি প্রকট৷ আর এই ঘাটতি কমিয়ে আনা গেলে সংখ্যালঘুরা বর্তমান আইনি কাঠামোতেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস৷
সূত্র: ডি ডব্লিউ
মন্তব্য চালু নেই