শুধু কাগজ কলমেই রয়ে গেছে ভিক্ষুকমুক্ত নগরীর কর্মসূচি

ভিক্ষাবৃত্তির অপবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করতে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেয় সমাজসেবা অধিদফতর। তবে দেশব্যাপী এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় সরকার। ভিক্ষুকরা সহসাই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরতে চান না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এরপর ঢাকা শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে কর্মসূচি নেওয়া হলেও সফলতার মুখ দেখেনি সেই কর্মসূচি। শুধু কাগজ কলমেই রয়ে যাওয়া কর্মসূচিটি ধীরে ছোট হয়ে আসছে। বর্তমানে এই কর্মসূচির সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে।

সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ‘ভিক্ষুকমুক্ত নগরী’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সমাজসেবা অধিদফতরে কোনো জনবল নেই। ২০১১ সালে ঢাকা শহরকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। তবে বর্তমানে আর কোনো কার্যক্রম নেই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫০ লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫০ লাখ টাকা সরকার বরাদ্দ দিলেও একটি টাকাও ছাড় হয়নি।

কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কোনো জনবলও নেই। অন্য ডেস্ক থেকে সাময়িকভাবে এই কর্মসূচির আওতায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সমাজসেবা অফিসার মোহাম্মদ আলী।

তিনি বলেন, ‘কর্মসূচির আওতায় দুই অর্থবছরে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। বর্তমানে এই কর্মসূচির জন্য আলাদা কোনো জনবল নেই। আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। একজন ছিলেন তিনি অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন।’

প্রাথমিকভাবে ময়মনসিংহ জেলার ৩৭ জন ভিক্ষুককে কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ৩৭ জন ভিক্ষুকের মধ্যে ১২ জনকে ১২টি রিকশা, ১৭ জনকে ১৭টি ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য পাঁচ হাজার করে টাকা এবং বাকি ৮ জনের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে তারা প্রায় সব‍াই কর্মসূচির আওতায় পাওয়া রিকশা-ভ্যান বিক্রি করে আগের পেশায় ফিরে গেছেন।

ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘৩৭ জন ভিক্ষুককে রিকশা-ভ্যান ও টাকা দিয়ে সহায়তা করা হয় যেন তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু তাদের মধ্যে ৩০ জনই সবকিছু বিক্রি করে ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় ফিরে গেছেন। এখন তাদের ঠিকানাও খুঁজে পাচ্ছি না।’

সমাজসেবা অধিদফতর থেকে জানা গেছে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ কর্মসূচির শুরু হয়। তবে ওই অর্থবছরে কর্মসূচির অনুকূলে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরে কর্মসূচি খাতে ৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বর্তমানে এই বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০ লাখ টাকায়। এত টাকা বরাদ্দ দিলেও ভিক্ষুকদের ভাগ্যের কোনো বদল হয়নি।

১০টি এনজিও’র মাধ্যমে ঢাকা মহানগরের প্রতিটি অঞ্চল থেকে ১ হাজার জন করে মোট ১০ হাজার ভিক্ষুকের জরিপ সম্পন্ন হয়। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ভিক্ষুকের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এই ডাটাবেজের তথ্য ব্যবহার করে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল।

কর্মসূচির ব্যাপক প্রচারণার জন্য পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে কর্মসূচির প্রচারণা সংক্রান্ত নাটিকা, ডকুমেন্টারি ও স্লোগান প্রস্তুত করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকা, বিটিভি এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারের ব্যবস্থাও হয়। এরপরও ভিক্ষুকমুক্ত হয়নি ঢাকা। এমনকি কর্মসূচির সফলতা প্রায় শূন্য।

পরবর্তীতে পাইলট পর্যায়ে জরিপকৃতদের মধ্য থেকে দুই হাজার জনকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় এক হাজার জনকে ময়মনসিংহ জেলায়, ৫০০ জনকে বরিশাল জেলায় এবং ৫০০ জনকে জামালপুর জেলায় পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা করা হলেও তা এখনও ঝুলে আছে।

কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আয়বর্ধক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা। কর্মসূচির আওতায় কিছু কর্ম-পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী কোনো কর্মসূচিই কাজে আসেনি।

৮টি পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিটিতে ২৫০ জন করে মোট দুই হাজার জন ভিক্ষুকের অস্থায়ী পুনর্বাসন করার কথা থাকলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে কর্মসূচি বাস্তবায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ভিক্ষুকদের সরাসরি অর্থ না দিয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে সমাজসেবা অধিদফতর।

সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, ‘ভিক্ষুকদের ধরে এনে আশ্রয় কেন্দ্রে দিচ্ছি কিন্তু তারা সেখানে থাকতে চান না। অনেকের কাছে ভিক্ষা একটা নেশার মতো হয়ে গেছে। ভিক্ষুকদের যে পেশা দেওয়া হোক তারা ভিক্ষাবৃত্তিই অধিক পছন্দ করেন। তাদের বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করলেও তারা সেগুলো বিক্রি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে চলে যান। ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিলেও ভিক্ষুকরা ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়তে চান না।’

পরবর্তী পদক্ষেপ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহ, রংপুর ও নদী ভাঙন এলাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি। এসব এলাকায় ক্ষুদ্র ঋণ ও ক্ষুদ্র শিল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।’

কর্মসূচিতে জনবল সংকট ও অর্থছাড়ে গড়িমসি প্রসঙ্গে এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, ‘আমাদের সমাজসেবা অধিদফতরেই জনবল সংকট রয়েছে। নতুন করে জনবল নিয়োগ হলে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান শীর্ষক কর্মসূচিতে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর বছর বছর টাকাও ছাড় করা হবে।’বাংলানিউজ



মন্তব্য চালু নেই