দেশে দেশে বর্ষবরনের আজব রীতি

নতুন বছর এলেই তাকে বরন করার নানা পরিকল্পনা করেন সবাই। ব্যক্তিগত আয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন দেশে নতুন বছরকে বরনের এমন কিছু রীতি রয়েছে যা সত্যিই খুবই বিচিত্র। বছরের পর বছর ধরে নতুন বছরকে বরন করে নেওয়ার ব্যতিক্রমী রীতিগুলো অনুসরণ হয়ে আসছে দেশগুলোতে। যা সঙ্গে মিশে আছে দেশগুলো ঐতিহ্য ও বিশ্বাস।

নতুন বছরের শুরুতে আসুন জেনে নিই ১৬টি দেশে নতুন বছরকে বরন করে নেওয়ার এমন কিছু ব্যতিক্রমী আয়োজন সম্পর্কে।

১. আঙ্গুর খেয়ে ইচ্ছা পূরণ :

বছর শুরু হওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে, অর্থ্যাৎ রাত ১২ টা বাজার কিছু আগে একে একে ১২ থেকে ১ পর্যন্ত গুনতে থাকেন স্প্যানিশরা আর প্রতিটি সংখ্যা বলার পর একটি করে আঙ্গুর মুখে দেন। প্রতিটি আঙ্গুর খাওয়ার পর তারা একটি করে ইচ্ছার কথা বলেন মনে মনে। ধারণা করা হয় এসময় ইচ্ছের কথা বললে সেটা পূরণ হয়। তবে এই ঐতিহ্যে আসল ইতিহাসটা কিন্তু একেবারেই ব্যবসায়িক।

১৮৯৫ সালের কথা। স্পেনের আঙ্গুর চাষীরা হঠাৎ খেয়াল করলেন যে তাদের ক্ষেতে এবার খুব বেশি পরিমাণে আঙ্গুরের ফলন হয়েছে। কিন্তু এত আঙ্গুর দিয়ে কি করা হবে! সব তো পচে যাবে! এমন ভাবনায় অতিষ্ট হয়েই এই ঐতিহ্যের শুরু করেন তারা যাতে করে তাদের আঙ্গুর পুরোটাই বিক্রি হয়ে যায়।

বাবা-মাকে চিঠি লেখা

বেলজিয়ামে নিউ ইয়ারের একটি বিশেষ নাম রয়েছে। সে হচ্ছে সিন্ট সিলভেস্টার ভোরানভন্ড। অন্য সব দেশের মানুষের মতন নতুন বছরের শুরুতে বেলজিয়ামেও নানারকম আনন্দ উৎসব পালিত হয়। তবে অন্যসব দেশের চাইতে আলাদাভাবে আরেকটি কাজ করেন তারা। আর তা হচ্ছে বাবা-মাকে চিঠি লেখা ও সেটা পড়ে শোনানো।

নানারকম কাগজ আর আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে বাবা-মাকে প্রথমে চিঠি লেখে ছেলেমেয়েরা এখানে। এরপর সেই চিঠি তাদের সামনে দাড়িয়েই জোরে জোরে পড়ে শোনানো হয়।

দরজার সামনে পেঁয়াজ ঝুলিয়ে রাখা

গ্রীসে নতুন বছরের শুরুতে দরজার সামনে একটি পেঁয়াজ বা ক্রেমিডা ঝুলিয়ে রাখা হয়। পেঁয়াজটি পরদিন সকালবেলায় বাবা-মা তাদের সন্তানদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই কপালে ছুঁইয়ে দেন। মনে করা হয় এর মাধ্যমে নতুন বছরে পুর্নজন্ম হবে নতুন রুপে।

তাই আগের দিন পেঁয়াজ ঝুলিয়ে রেখে পরদিন সকালে পেঁয়াজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তবেই চার্চে যায় তারা।

কেক খাওয়া ও বাসনপত্র ভাঙা

ডেনমার্কে নতুন বছরের শুরুকে উদযাপন করার জন্যে খাবার দাবার খাওয়া শেষে প্রচন্ড বিশাল একটি কেক খাওয়া হয়। ক্রানসিকাগে নামক এই বৃহত আকৃতির কেকটি শেষ করে এরপর সবাই মিলে অন্যদের দরজায় থালা-বাসন ভাঙতে শুরু করেন।

মনে করা হয় এরকমটা করলে পরের বছর উক্ত ঘরের বাসিন্দাদের বন্ধুসংখ্যা বেড়ে যাবে।

থ্যঙ্ক ইউ কার্ড পাঠানো

জাপানে মনে করা হয় নতুন বছরের শুরুতে নিউ ইয়ারের গড তোশিগামি আকাশ ছেড়ে নীচে, এই পৃথিবীতে নেমে আসেন। আর তাই এই রাতে তারা নিজেদের ঘর খুব সুন্দর করে পরিস্কার করে সাঁজিয়ে গুছিয়ে রাখেন।

সেই সঙ্গে আশপাশের সবাইকে থ্যঙ্ক ইউ কার্ড পাঠায়।

১২ পদের খাবার খাওয়া

বছরের শুরুতে এস্তোনিয়ার বাসিন্দারা ক্ষেত্রভেদে সাত, নয় কিংবা বারো পদের খাবার খেয়ে থাকেন। তাদের বিশ্বাস এতে করে যে যত পদের খাবার খাবে পরবর্তী বছরে তার শক্তি ঠিক ততগুন হয়ে যাবে। তবে নিজেদের খাবারের সবটা খেয়ে ফেলে না তারা সেসময়।

তারা বিশ্বাস করে, এই রাতে নিজেদের পূর্ববর্তী মৃত মানুষেরা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তাদের জন্যেই কিছুটা খাবার রেখে দেয় তারা।

গলে যাওয়া টিন থেকে ভবিষ্যদ্বানী করা

ফিনল্যান্ডে নতুন বছরের শুরুতে এক টুকরো টিন নিয়ে সেটাকে প্রথমে আগুনের ভেতরে গলানো হয়। এরপর সেটা গলে গেলেই ছুঁড়ে ফেলা হয় ঠান্ডা পানিতে।

ঠান্ডা হয়ে গেলে তারপরেই টিনের (সীসা) টুকরোটিকে নিয়ে যাওয়া হয় মোমবাতির কাছে আর এর ওপর ভিত্তি করেই বলা হয় কেমন যাবে মানুষটির সামনের বছর। ভবিষ্যদ্বাণী করার এই উপায়টিকে এখানে বলা হয় মোলিবডোমেন্সি।

অতিথি দেখে নতুন বছরকে বোঝা

আয়ারল্যান্ডের কুসংস্কার অনুসারে, ৩১ ডিসেম্বরের রাতে যে বা যারা ঘরে অতিথি হিসেবে পা রাখবে তাদের ওপরেই নির্ভর করবে গৃহকর্তার ভাগ্য। যদি অতিথি হয় লম্বা, কালো আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাহলে বুঝতে হবে যে, গৃহকর্তার সামনের বছরটা খুব ভালো যাবে।

আর লাল চুলের নারী আসলে বুঝতে হবে যে সামনের বছরে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে। এ ছাড়াও আইরিশ অবিবাহিত নারীরা এই রাতে নিজেদের বালিশের তলায় এক ধরনের লতা রেখে দেন। মনে করা হয় এটি তাদের ভবিষ্যতের ভালো থাকা ও স্বামী খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।

টেলিভিশনে সাদা-কালো ক্যাবেরে নাচ দেখা

নতুন বছরের শুরুতে জার্মানিরা মার্জিপান দিয়ে তৈরি শূকর খেতে পছন্দ করে। এছাড়াও এই রাতে ১৯২০ সালের ধারণকৃত ক্যাবেরে নাচ দেখে তারা।

যেটা কিনা প্রতি বছরের শুরুতেই একটা বিশেষ উদাযাপন হিসেবে প্রচার করা হয় জার্মান টিভি চ্যানেলগুলোতে। সাদা-কালো সময়ের সেই ক্যাবেরে নাচ দেখতে দেখতে রাতের খাবার সারেন তারা।

দুইবার নিউ ইয়ার পালন করা

শুনতে অদ্ভূত লাগলেও সত্যি যে মেসিডোনিয়ায় একবার নয়, বরং পরপর দুইবার উদযাপন করা হয় নিউ ইয়ার। একবার ৩১ ডিসেম্বর, এবং অন্যটি ১৪ জানুয়ারি।

জুলিয়ান ও লুনার দিনপঞ্জিকার কারণে তৈরি হওয়া মেসিডেনিয়ার অর্থোডক্সের কারনেই এমনটা করেন তারা। ৩১ তারিখে আতশবাজির উৎসব করেন তারা আর ১৪ জানুয়ারিতে বড়দের কাছ থেকে নানারকম উপহার পেয়ে থাকে বাচ্চারা।

স্যুটকেস নিয়ে ঘরের চারপাশে হাঁটা

বছরের শুরুতে ঘড়িটা ১২টার কাছে পৌঁছানোর আগেই সীমের বীচি খেয়ে নেয় আর্জেন্টাইনরা। কারণ, এতে করে তাদের পরবর্তী বছর ভালো যাবে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

এ ছাড়াও রাতের বেলায় একটা স্যুটকেস নিয়ে ঘরের চারপাশে কয়েক পাক ঘুরে নেয় তারা। কারণ মনে করা হয় যে, এতে করে তাদের বিদেশ ভ্রমণের সম্ভাবনা বাড়বে।

শত্রুর প্রতিমূর্তি পোড়ানো

পুরো বছরে যে মানুষটি সবচাইতে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে কিংবা যাদের দ্বারা ক্ষতিসাধন হয়েছে, ইকুয়েডরবাসীরা তাদের পুতুল তৈরি করেন। আর তারপর সেটা রাস্তায় নিয়ে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন।

নিজের শত্রুদের ওপর মনের রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা এভাবে।

ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা

চীনে বছরের শুরুতে ঘরের সব ময়লা ঝেড়ে-মুছে একেবারে সাফ করে ফেলা হয়। মনে করা হয় এভাবে ঘরের মতো জীবনের সবরকম দূর্ভাগ্যকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় এতে করে।

এ ছাড়াও নানারকম উৎসব এবং উপহার আদান- প্রদান হয় এসময় কাছের মানুষের ভেতরে।

সান্তা ক্লজের অপেক্ষা করা

সার্বিয়াতে বছরের শুরুর দিনটাকে বড়দিন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। মনে করা হয় এই দিনে সান্তা ক্লজ আবার আসবেন আর উপহার দিয়ে যাবের সবার জন্যে।

এজন্যে ক্রিসমাস ট্রি রাখা হয় ঘরে। সেটাকে সাজানো হয় আর অপেক্ষা করা হয় সান্তা ও তার উপহারের জন্যে।

আত্মত্যাগের প্রতীকের নৃত্য

ইরানে বসন্তের শুরুকে বছরের শুরু বলে মনে করা হয়। আর এসময় আত্মত্যাগের প্রতীক ডোমুজি তৈরি করেন তারা। প্রতীক হিসেবে অভিনয় করা মানুষটির মুখ কালো রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ভালো ভাগ্যের শুরুকে উদযাপন করতে রাস্তায় রস্তায় নেচে বেড়ান তারা।

আতশবাজির উৎসব করা

অন্যান্য অনেক দেশে আলোর উৎসব করা হলেও নতুন বছরের শুরুতে সবচাইতে জমকালো আতশবাজির উৎসব হয় চেক রিপাবলিকে।

পুরো আকাশ ছেয়ে যায় আলোয় আলোয়। অনেকটা আমেরিকার মত এসময় সবাই সবাইকে অভিনন্দন জানান। পাশাপাশি আনন্দ করে ও ভালো সময় কাটান তারা বছরের শুরুতে।



মন্তব্য চালু নেই