ভারতে ‘লাভ জিহাদ’ তোলপাড়
ভারতে ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে তোলপাড় চলছে। এর পক্ষে কোনো প্রচার-প্রচারণা নেই। বিরুদ্ধাচরণকারীরা-ই বিষয়টিকে তুলে এনেছেন আলোচনার শীর্ষে। লাভ জিহাদ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে খবর বের হচ্ছে। এখন প্রসঙ্গটি বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।
লেখার বিস্তারে যাওয়ার আগে বলে রাখি লাভ জিহাদ কী। কেন-ই-বা তা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, তাও বলে নেওয়া ভালো।
লাভ জিহাদ টার্মটি বেশি পুরোনো নয়, বড় জোর পাঁচ বছর হবে প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হচ্ছে। টার্মটির উপত্তি ভারতে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ থেকে। লাভ জিহাদের কেন্দ্রীয় ধারণায় বলা হচ্ছে, ভারতীয় মুসলমান পুরুষরা হিন্দু নারীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এবং হিন্দু নারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হচ্ছে। এ উপায়ে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তবে খ্রিস্টানদের দিকেও অভিযোগের তীর ছুড়েছেন হিন্দু-ইজমে বিশ্বাসী ভারতের কিছু নেতা ও সমাজকর্মী। প্রেম, অর্থ এবং চাকরি- এ উপকরণগুলো ব্যবহার করে চার্চের যাজকরা হিন্দু নারী-পুরুষদের খ্রীষ্ট ধর্মে দিক্ষীত করাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে চীনাদের প্রতিও। বলা হচ্ছে, ভারতের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে চীনা পুরুষরাও নাকি টার্গেট করেছেন হিন্দু নারীদের।
এই হলো ভারতে লাভ জিহাদ এবং আলোচনা-সমালোচনার মূল কারণ। তবে অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন মুসলমানরা। ভারতে মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এবং হিন্দু ধর্মকে ‘অসার’ প্রমাণ করতে ‘লাভ জিহাদ’ পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কারা, কোথা থেকে এ জিহাদ পরিচালনা করছেন?
লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারীরা এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। সম্প্রতি জি নিউজসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বের হয়, অন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম ও তার সমগোত্রীয় মুসলমান ডনরা লাভ জিহাদে বিনিয়োগ করছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই ডনরা ভারতের বিনোদনজগতে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনোয়োগ করে সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক প্রযোজনা করাচ্ছেন। এসব গল্পের কেন্দ্রে থাকে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমান ছেলের প্রেম, বিবাহ এবং উপসংহারে সংসারে উত্তরণ। বিষয়টিকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ‘ছায়া যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা লাভ জিহাদকে আরো উসকে দিচ্ছে।
বিষয়টি দেশটির সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত শুক্রবার ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির সদ্য বিদায়ী সভাপতি রাজনাথ সিং লাভ জিহাদ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রশ্ন তোলেন- ‘লাভ জিহাদ কী? বিষয়টি আমি জানতে চাই।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, লাভ জিহাদ টার্মটি ভারতে প্রথম শোনা যায় ২০০৯ সালে। ওই সময় ভারতের কেরালা এবং বেঙ্গালুরুতে ধর্মান্তরিত হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা শোনা যায়। প্রায় সমসাময়িক সময়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০০৯, ২০১০, ২০১১ এবং দুই বছর বাদে ২০১৪ সালে ভারতে লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু হয়। ভারতের উত্তরাঞ্চলে এ নিয়ে তদন্ত পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু সংগঠিত উপায়ে লাভ জিহাদের কোনো বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায়নি। তারপরও বর্তমানে এটি একটি বড় ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো, ‘লাভ জিহাদ’ ও ‘সেক্স জিহাদ’ এক নয়। সেক্স জিহাদের উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোতে। তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া এবং সবশেষে আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে সেক্স জিহাদ টার্মটি জড়িত। তথাকতিথ ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব জঙ্গিরা দিনের পর দিন লড়াই করছেন, তাদের দেহিক চাহিদা মেটাতে ও মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সমমনা নারীরা ওই সব জঙ্গিকে সঙ্গ দেবেন- এই হলো সেক্স জিহাদের মূল কথা। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেক খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু ভারতে লাভ জিহাদ টার্মটি ধর্মীয় আগ্রাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বিষয় হিসেবে দাবি করেছেন এর বিরুদ্ধতাকারীরা। সম্প্রতি ভারতে এই টার্মটি নিয়ে গণমাধ্যম গরম করেছেন উত্তরপ্রদেশের সংসদ সদস্য যোগী আদিত্যনাথ। তিনি বিজেপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় লাভ জিহাদ প্রসঙ্গটি তিনি বারবার তুলেছেন। ভারতে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হিসেবে নিজেকে উত্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে লাভ জিহাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বিজেপি নেতা উশা ঠাকুরও আদিত্যনাথের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘হিন্দুত্ব’ বাঁচাও স্লোগান তুলেছেন। এই সারিতে আছেন আরো অনেক বেজিপি নেতা।
এখন প্রশ্ন হলো- লাভ জিহাদকে বিজেপি নেতারা কি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, নাকি সত্যিই এর কোনো অস্তিত্ব রয়েছে? এর উত্তরে যাওয়ার আগে বলতে হয়, সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু গেল মাস আগস্টে আরএসএসের সভাপতি মোহন ভাগবত ঘোষণা করেন, ‘যারা ইংল্যান্ডে বাস করেন, তারা ইংলিশ। যুক্তরাষ্ট্রে বাস করলে তারা আমেরিকান। জার্মানিতে বসবাসকারীরা জার্মান। একইভাবে যারা হিন্দুস্তানে (ভারত) বসবাস করেন তারা হিন্দু।’
গত শুক্রবার শিবসেনা নেতা রাজেশ্বর সিং ঘোষণা দেন, ‘হিন্দু তরঙ্গ সবে শুরু হয়েছে। আগামী ১০ বছরের ভারতের সব খ্রিস্টান ও মুসলমানকে হিন্দু ধর্মে আনা হবে।’ ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমান রয়েছে, যা মোট ভারতীয় জনগণের ১৫ শতাংশের বেশি এবং দেশ হিসেবে তৃতীয় বৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। রাজেশ্বর সিংয়ের এ ঘোষণা যে শেষপর্যন্ত বাগাড়ম্বরই হবে, তা এখনই বলা যায়।
ভারতের লাভ জিহাদ প্রসঙ্গটি বিশ্বজুড়ে আলাপ-আলোচনায় এসেছে। শিকাগো ট্রিবিউন এবং ফরেন পলিসি পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাভ জিহাদের ভিত্তি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মধ্যে নিহিত। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ বিভাগের ফলে দুই দেশের মধ্যে অগণিত অভিবাসী ঢুকে পড়ে এবং উভয় পক্ষ একে অপরের ওপর নির্যাতন চালায়। ইতিহাসের সেই পুরোনো ক্ষত স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরে খুঁচিয়ে বড় করা হচ্ছে।
এদিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক খবরে বলা হয়, হিন্দু-মুসলমানের বিবাহের বিষয়টি গুটি কয়েক রাষ্ট্রে বেশি দেখা যায়। কিন্তু দেশ ভারতে এর প্রভাব খুব বেশি নেই। শুধু তা-ই নয়, অনেক বিজেপি নেতাও লাভ জিহাদ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। এতে সাম্প্রদায়িত দাঙ্গার সৃষ্টি হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
তবে বিজেপি সরকার গঠনের পরে বিজেপি নেতারা যেভাবে হিন্দু-ইজমকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছেন, তাতে ফল ভালো হবে বলে মনে হয় না। ভিন্ন দুটি ধর্মানুসারীর মধ্যে বিবাহের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধারা হাজার বছরের পুরোনো। ভারতে হিন্দু-মুসলমানের বিবাহ যদি হিন্দু ধর্মের জন্য অশনিসংকেত হয়ে ওঠে, তবে সামাজিক উপায়ে তা মোকাবিলার বহু পথ দেশটির হাতে রয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতি করলে তার প্রভাব গোটা বিশ্বের হিন্দু-মুসলমানে ওপর পড়বে। লাভ জিহাদের অজুহাতে মুসলমানদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ করা হলে, তাতে পিছিয়ে পড়বে ভারত-ই। ধর্মকে ইস্যু না করে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ধরে রাখতে পারলেই একটি আধুনিক ভারত বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মন্তব্য চালু নেই