প্রশাসনের চোখ এড়াতে সর্বনাশা ইয়াবা ব্যাবসায় এবার অভিনব কৌশল
দিন যত যাচ্ছে, ততই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ইয়াবাব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের কড়া নজরদারি এড়াতে এবার ভি।ন্ন কৌশল মাদক ব্যাবসায়ীদের । ট্যাবলেট হয়ে ঢুকতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবার তরল হয়ে ঢুকছে সর্বনাশা এ মাদক। দেশি-বিদেশি মাদক পাচারকারীরা ইয়াবার কেমিক্যাল দেশে এনে ট্যাবলেট তৈরি করে দেশের বিভিন্নস্থানে বাজারজাত করছে। এরইমধ্যে বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ইয়াবা তৈরির কেমিক্যাল আটক করছে। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে হাজার হাজার ইয়াবার চালান আটক করছে। ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, দেশি-বিদেশি মদ, কোকেন ও আফিমকে ছাড়িয়ে মাদকের বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে গোলাপি রংয়ের এই ট্যাবলেট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আলী আকবর নামের ইয়াবা তৈরির এক কারিগরকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স পাস করেন। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে আকবর জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করতেন। পরে বিভিন্ন কাঁচামাল ও কেমিক্যাল দিয়ে ইয়াবা তৈরি করে বাজারজাত করতেন।
বিজিবি ও পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি এলাকায় মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত এসে মিশেছে। এই এলাকাটি অনেকটা ‘নো ম্যানস ল্যান্ডের’ মতো। এই স্থানটিকেই ইয়াবা তৈরি ও পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে মাদক পাচারকারীরা। এ সব ইয়াবা কখনও ভারতের মিজোরাম হয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তের অনেক অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা দিয়েও অবাধে ইয়াবা ও এর উপকরণ দেশে ঢুকছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইয়াবা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে মেটাফিটামিন ও সিউডোফিড্রিন। এগুলো মিয়ানমার ও ভারতের বাজারে খুবই সহজলভ্য। এ সব রাসায়নিক দিয়ে সাধারণত সর্দি-কাশি উপশমের ওষুধ তৈরি করা হয় বলে এগুলো কিনতে ক্রেতাকে তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না। তাছাড়া ইয়াবা তৈরি করতে বড় কারখানারও প্রয়োজন হয় না।
দেশের ভেতরে ইয়াবার প্রধান রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে প্রতিদিন হাজার-হাজার ইয়াবার চালান আসছে রাজধানীতে। তৈরি হচ্ছে রাজধানীতেও। যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, পোস্তগোলা, সায়েদাবাদ, ওয়ারী, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ও পুরান ঢাকার এলাকা থেকে এসব ইয়াবার চালান হাতবদল হচ্ছে। যাত্রাবাহী বাস, কার, মাইক্রো ছাড়াও পণ্যবাহী ট্রাকেও আসছে ইয়াবা। নানা কৌশলে ইয়াবা দেশের প্রত্যন্ত এলাকাও চষে বেড়াচ্ছে।
গত সপ্তাহে খিলগাঁওয়ে একটি পণ্যবাহী ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে ট্রাকের চালক ও সহকারীকে।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পূর্ব) মাহবুব আলম বলেন, সার বোঝাই ট্রাকটিতে করে লুকিয়ে খিলগাঁও পর্যন্ত এই ইয়াবার চালান নিয়ে আসা হয়। এ চালানটি প্রথমে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে যায় মাইক্রোবাসে। সেখান থেকে ট্রাকের চালককে চুক্তির মাধ্যমে এ চালান দেওয়া হয়। চালানটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক ব্যক্তির নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়। তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
এর আগে ১৬ আগস্ট শ্যামপুর এলাকায় সম্রাট কমিউনিটি সেন্টারের সামনে গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে এক লাখ ১৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। এ চালানটিও টেকনাফ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো একটি মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে ঢুকিয়ে।
গত ২১ জুলাই ওয়ারী এলাকার বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অফিসকক্ষ থেকে ৭৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ আবু সিদ্দিক (১৫) নামের এক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বিটিসিএল-এর কর্মী মো. মোস্তফা ওই অফিসে ইয়াবা মজুদ করে ব্যবসা করছিল। ঘটনার পর মোস্তফা পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গত ১০ আগস্ট বারিধারা এলাকা থেকে ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এ অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ছাব্বির হোসেন টেকনাফ থেকে ইয়াবা এনে ভাড়া বাসায় রেখে বিক্রি করতেন। অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মানজুরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীতে ইয়বার রুট বন্ধে আমরা সক্রিয় আছি। গত দুই মাসে লক্ষাধিক ইয়াবা উদ্ধার ৩৭টি মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৪জনকে।
বিজিবি’র গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সীমান্ত দিয়েই প্রতি মাসে প্রায় দুই কোটি পিস ইয়াবা ট্যাবলেট রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য দুই শ’ কোটি টাকারও বেশি। সাগর ও নদীপথ ছাড়াও প্রায় ৫৪ কিলোমিটার উন্মুক্ত মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ৪০টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ও এর উপকরণ ঢুকছে বাংলাদেশে। এ সময়ে মাদক পাচারের ঘটনায় র্যাবের হাতেই সারা দেশে আটক হয়েছে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মাদকদ্রব্যের ব্যবসা ও রুট বন্ধ করতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নিয়মিত অভিযান চলছে রাজধানীতে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আটক করা হচ্ছে। মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছেন তারা।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম জানান, সারাদেশেই এখন ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও কোম্পানি দেশের বিভিন্নস্থান থেকে বিগত আট মাসে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি ২০ লক্ষাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজিবি’র সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ মোহসিন রেজা বলেন, বাহিনীর বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও ইউনিটের সদস্যরা ইয়াবা ট্যাবলেট ও ইয়াবার উপকরণ কেমিক্যাল আটক করেছে। গত আগস্ট মাসেই কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে পাঁচলাখ ৪৫ হাজার ৭৮২ পিস ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির উপকরণ আটক করেছে বিজিবি।
মন্তব্য চালু নেই