খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সাঁওতালদের মামলার বাদীকে

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী স্বপন মুরমুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

গত ১০ দিন ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তবে স্বপন মুরমু নিখোঁজ নাকি মামলার স্বার্থে তাকে অপহরণের পর গুম করে রাখা হয়েছে- এ নিয়ে সন্দেহ ও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

স্বপন মুরমু দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মুরমুর ছেলে। তিনি পেশায় বাঁশের কারিগর। বাঁশের তৈরি ডালি, কুলা, চালন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি।

এর আগে, গত ৬ নভেম্বরে ঘটনার ১০ দিন পর ১৬ নভেম্বর গভীর রাতে স্বপন মুরমু বাদী হয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামি করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলার পর এ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এছাড়া গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্বপন মুরমুর স্ত্রী জোসনা মার্ডি জানান, ৬ নভেম্বরের ঘটনার আগে ও পরে তার স্বামী বাড়িতেই ছিলেন। ১০ দিন আগে কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। তখন থেকে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। এমনকি তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও হয়নি। তিনি মামলা করেছিলেন কিনা- তা জানা ছিল না। তবে পরে বিষয়টি জানতে পারি।

তবে স্বামী নিখোঁজের বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি।

স্বপনের মা ঈষা রানী হেমভ্রম বলেন, গত ১০ দিন ধরে তার ছেলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রতকুমার সরকার জানান, স্বপন মুরমু সাঁওতালদের ওপর হামলা, সংঘর্ষ ও তিন সাঁওতাল হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বাদী। স্বপন মুরমুর নিখোঁজ কিনা বিষয়টি তার জানা নেই। এমনকি তার নিখোঁজের বিষয়ে পরিবার বা অন্য কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।

এদিকে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম আদিবাসী ভূমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাসকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কিছু লোকজনকে হয়রানি, সাঁওতালদের প্রশ্নবিদ্ধ ও বিশেষ প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ রক্ষায় স্বপনকে দিয়ে মামলাটি দায়ের করান একটি প্রভাবশালী মহল। মামলাটি নিয়ে আগে থেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছিল সাঁওতালরা।

তিনি আরও জানান, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি থেকে উচ্ছেদ ও সাঁতালদের ওপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও তিন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যা ঘটনার ২০ দিন পর ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের পক্ষে সাপমারা ইউনিয়নের হরিণমারী নতুরন পল্লি গ্রামের মঙ্গল হেমরমের ছেলে থোমাস হেমব্রন বাদী হয়ে ৩৩ জন নামীয় ও অজ্ঞাতনামা ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে আসামি দেখিয়ে শনিবার বিকেলে গোবিন্দগঞ্জ থানায় এজাহার দায়ের করেন।

এজাহারে আসামি হিসেবে গাইবান্ধা-৪ আসনের (গোবিন্দগঞ্জ) সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হান্নান, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাকিল আহম্মেদ বুলবুল ও কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করীম রফিক, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ফকুর নাম রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৬২ সালে বেশ কয়েকটি গ্রামের সাঁওতাল বাঙালিদের কাছ থেকে ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ। সেই জমিতে ইক্ষু খামার গড়ে তোলা হয়। কিছুদিন জমিতে আখ চাষ করলেও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে জমি লিজ দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ।

ফলে আখ চাষের পরিবর্তে জমিতে ধান ও তামাক চাষ করা হতো। পরে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে জমি ফিরে পেতে আন্দোলনে নামেন আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। গত ১ জুলাই সাঁওতালা একত্রিত হয়ে জমি দখল নিয়ে ঘর নির্মাণ, ধান, পাট, ডাল ও সরিষা চাষ করেন।

গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের আখ কাটাকে কেন্দ্র করে খামারের জমি দখলকারী আদিবাসী সাঁওতালের সঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাঁওতালদের ছোড়া তীর-ধনুকের আঘাতে ৯ পুলিশ তীরবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হন।

এরপর বিকেলে তাদের উচ্ছেদ করে ঘরে আগুন দেয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত সাড়ে ৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। এ মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করেছে।



মন্তব্য চালু নেই