১৫ বছর টাকা ছুঁয়ে দেখেননি যে নারী

‘টাকাটাই শেষ কথা/ বাকী সব বাতুলতা/ টাকা কথা রাখে’… ওপার বাংলার নন্দিত গায়ক কবীর সুমনের গানে এইযুগের যে বাস্তবতা হাজির হয়েছে; তাকে পুরোপুরি মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছেন জামার্নির এক স্কুল শিক্ষক। গেলো ১৫ বছর হাত দিয়ে টাকা ছুঁয়ে দেখেননি তিনি। কোনো লেনদেন করেননি অর্থমুদ্রা ব্যবহার করে। ৬৯ বছর বয়সী জার্মান নারী হাইডমেরি শুয়ারমার। টাকা ব্যবহার না করে, কী করে টিকে আছেন তিনি এই প্রবল বাজার অর্থনীতির যুগে?

২২ বছর আগে বিয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে দুই সন্তানকে নিয়ে জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরে স্থানান্তরিত হন হাইডমেরি। নতুন পরিবেশ বদলে দেয় তাঁর জীবন বাস্তবতাও। শহরে আশ্রয়হারা এক বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কষ্ট ভীষণভাবে মর্মাহত করে তোলে তাকে। আর এ মর্মবেদনা থেকে হঠাৎ করে হাইডমেরির মাথায় উদয় হয় নতুন এক চিন্তার।

ভাবতে থাকেন, কোন ধরনের মুদ্রার লেনদেন ছাড়াই সমাজে বেশ ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে আশ্রয়হীনরা। আর সে চিন্তাকে মাথায় রেখে হাইডমেরি খুলে বসেন এক বিনিময়ের দোকান। হাউডমেরির ওই দোকানে অর্থের বিনিময়ে নয়, বরং লেনদেন চলে কোন বস্তুর বিনিময়ে বস্তু, সেবার বিনিময়ে সেবা, কাজের বিনিময়ে কাজ কিংবা দক্ষতার বিনিময়ে দক্ষতার। পুরনো কাপড়ের বিনিময়ে রান্নাঘরের সরঞ্জামাদি কিংবা সীসার তৈরি জিনিসপত্রের বিনিময়ে গাড়ির সেবা এ ধরনের নানান বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা হয় সে দোকানে।

আর এভাবে হাইডমেরির সে ছোট্ট দোকানটিতে নিজেদের দক্ষতা আর পুরনো জিনিসপত্রকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেলেন বেকাররা। তবে শুরুটা যে হাইডমেরির জন্য খুব সহজ ছিল তা নয়, বরং আশ্রয়হীনদের বিশ্বাসযোগ্যতা পেতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে তাকে। এ ধরনের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক নারী তাদের সত্যিকারের কষ্ট বুঝতে পারবেন এমনটা বিশ্বাস করতে চাননি ঘরহারারা।

গিভ এন্ড টেক দোকান খোলার আগে থেকেই জীবন যাপনে পরিবর্তন নিয়ে আসেন হাইডমেরি। ডর্টমুন্ড শহরে আসার পর শুরুতে হাইডমেরির মনে হল; প্রয়োজন নেই এমন অনেক জিনিস আছে তার সংগ্রহে। তখন নতুন কোন কিছু কেনার আগে পুরনো জিনিস কাউকে বিলিয়ে দেয়ার মাঝে সুখ খুঁজে বেড়াতেন তিনি। যে লোক রান্নাঘরে বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে ছোটখাটো নানা কাজ করে তার চেয়ে নিজের মর্যাদাকে উঁচু করে দেখতে চাননি হাইডমেরি। আর সেকারণেই কাজ করেছেন বাসন ধোয়ারও। এর জন্য পেতেন ঘন্টা হিসেবে মজুরি।

আর ১৯৯৫ সালেই প্রথম সিদ্ধান্ত নিলেন অর্থমুদ্রা ব্যবহার না করার। এক বছরের মাথায় জীবনের বাস্তবতায় তাঁর সন্তানরাও ছেড়ে দেন ডর্টমুন্ড শহর। আর এর পরপরই নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে পুরোদস্তুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করেন হাইডমেরি। আর তখন থেকে অর্থমুদ্রার ব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন হাইডমেরি। গিভ এন্ড টেক দোকানের নিয়ম নীতি থেকে একটুও সরে আসেননি তিনি। দোকানের সদস্যদের ছোট ছোট প্রয়োজন পূরণ করে নিজের আনন্দ খুঁজে ফেরেন তিনি। উপভোগ করেন প্রতিটি মুহূর্ত।

মুনাফার যুগে হাইডমেরির এই মানবিক উদ্যোগ, স্বপ্ন দেখা মানুষদের জন্য যেন এক ছোট্ট আশার আলো।



মন্তব্য চালু নেই