সাদ্দামের আলোচিত সেই বিশাল বন্দুক
যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পশায়ারের ফোর্ট নেলসন বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজকীয় অস্ত্রাগার প্রদর্শণের জন্য। সেই মান্ধাতা আমলের ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান আমল ব্যবহৃত নানান অস্ত্র এই দুর্গে রাখা আছে। অস্ত্রাগার দুর্গটির সামনে দুটো বিশালাকার স্টিলের পাইপ দন্ডায়মান। দেখলে মনে হতে পারে, যে কেউ চাইলে ওই স্টিলের পাইপ বেয়ে উঠে যেতে পারে অনেকটা দূর। দেখে খুব সাধারণ কোনো স্টিলের বড় পাইপ মনে হলেও আদতে কিন্তু এই দুটি পাইপের একটি অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল। বিশ্বে একটা সময় যে বিশাল বন্দুক বানানো শুরু হয়েছিল সেই বিশাল প্রকল্পের একটি ছোটো নমুনা হলো এই বিশাল স্টিলের পাইপ। একে বলা হলো ‘সুপারগান’ বা বিগ ব্যাবিলন। ১৫৬মিটার লম্বা ব্যারেল থেকে কক্ষপথে স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করা যাবে এমনটা ভেবেই তৈরি করা হয়েছিল ওই সুপারগান।
এই সুপারগানের উদ্ভাবক হলেন কানাডার উদ্ভাবক জেরাল্ড বুল। বিশ্বের প্রথম সারির অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তিনি অন্যতম। রকেট ব্যবহার না করে কিভাবে এই সুপারগান দিয়ে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো যায় তাই ছিল তার অনেক গবেষণার মাঝে একটি গবেষণার বিষয়। ব্রিটিশ রয়েল আর্মারির সংরক্ষক নিকোলাস হলের ভাষ্যমতে, ‘বুল ছিল একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী এবং চারিত্রিক দিক দিয়ে চমৎকার একজন মানুষ। তার শারিরীক আকৃতি দেখে বোঝার উপায় ছিল না তিনি এত বিশাল সব অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম।’ কিন্তু মজার বিষয় হলো বিগ ব্যাবিলন যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরির কথা ছিল তা বাস্তবে হয়নি। তবুও এই বিশাল বন্দুকটি নিয়ে আজও আগ্রহের শেষ নেই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে।
এমন একটা সময় আসলো যখন বিশ্বের অধিকাংশ সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রগুলোই বুলের কাছে অনেক দাবি দাওয়া নিয়ে আসতে শুরু করলো। কারণ ওই সময়টাতে প্রতিটি সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রই একে অপরের শত্রু হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের ডামাডোলে। তখন বুল নিলেন এক অবাক করা সিদ্ধান্ত। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্সের দাবি পর্যন্ত মানলেন না, কিন্তু ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দাম হুসেইনের জন্য তিনি সুপারগান তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। আর ওই সিদ্ধান্ত শেষমেষ হত্যাকাণ্ডে গিয়ে শেষ হয়।
ওই ঘটনার কয়েক দশক পর বুলের সুপারগান তৈরির আবারও প্রশ্নটি ফিরে আসে। কারণ অনেকেই মনে করেছিলেন তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বুঝি সুপারগানেরও মৃত্যু হলো। ১৯৬০ সালের দিকে বুল কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের হয়ে সুপারগান তৈরির জন্য গবেষণা করেছিলেন। তখন প্রকৌশলীরা তার নকশা অনুযায়ী সুপারসনিক বিমান তৈরিরও চেষ্টা করেছিলেন। বুলের নকশা অনুযায়ী এই বিমানের জন্য কোনো দামি উইন্ড টানেল দরকার হবে না। স্রেফ একটি বড় বন্দুকের ভেতর থেকে উৎক্ষেপন করলেই হবে এমটাই ছিল বুলের ভাষ্য। কিন্তু তৎকালীন সময়ে সেই প্রকল্প আলোর মুখ না দেখলেও বুল কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ফান্ডের বিনিময়ে অনেক শক্তিশালী বোমা তৈরি করেছেন। যদিও তার ব্যক্তিগত ইচ্ছে ছিল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের জন্য সুপারগান তৈরি করা, মিসাইল ছোড়ার জন্য না।
কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু হিগিন্সের মতে, ‘অল্প খরচের বিষয়টি খেয়াল রাখবার মতো বিষয় ছিল। একটা বিশাল বন্দুক ব্যবহার করে কোনো কিছু ছুড়ে দিলে একদিকে যেমন খরচ অনেক কম হয়, তেমনি আবার পুনরায় ব্যবহারও করা যায়। ছোটোখাটো ক্রুটি হলে তা ঠিকও করে নেয়া যায়। যা বর্তমান পন্থাগুলোতে হয় না। রকেট উৎক্ষেপনকারী লাঞ্চারগুলো একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা আর ঠিক করা যায় না।’ ১৯৬১ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার যৌথ উদ্যোগে গঠিত প্রকল্প হাই অ্যালটুচিউড রিসার্চে(হার্প) কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি এবং তার সহকর্মীরা পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের জন্য কয়েকবার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যয় সামলাতে না পেরে শেষমেষ ১৯৬৭ সালে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে অনেকেরই ধারণা বুল ওই সুপারগান বা স্পেসগান তৈরি করতে পেরেছিলেন হার্পে থাকাকালীন সময়ে।
অধ্যাপক হিগিন্সের মতে, ‘হার্পের কাছে যে বন্দুকগুলো রয়েছে বুলের তৈরি করা তা দিয়ে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত কিছু ছুড়ে মারা যায়। তবে এই ছোড়ার ক্ষেত্রে যদি গ্যাস ব্যবহার করা হয় তাহলে আরও অনেকটা দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর এই বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার জন্য একটি গাড়িও ব্যবহার করতে হয়।’ অনেকের মতেই এই বন্দুক দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট ছুড়ে দেযার ব্যাপারটি হাস্যকর। কারণ তারা জি ফোর্সকে সামনে নিয়ে আসেন মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। কিন্তু এক্ষেত্রে হিগিন্স বলেন, ‘সেনাবাহিনীর আর্টিলারি বোমাগুলোতে বর্তমানে জিপিএস এবং লেজার গাইডেন্স ব্যবস্থা থাকে। এমনকি বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও করা থাকে বোমার অন্যান্য ফাংসানগুলোকে ঠিক রাখার জন্য। তাহলে ঠিক একই কায়দায় ওই জি ফোর্সকেও মোকাবেলা করা সম্ভব। তবে সবকিছুই যে ওই বন্দুক দিয়ে ছোড়া যাবে তা কিন্তু নয়।’
বুল যেভাবেই হোক তৎকালীন ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এই সুপারগানই হলো আগামীর ভবিষ্যত। কিন্তু ১৯৭০ সালের দিকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ক্ষমতাধর দেশই সুপারগান সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর তখন প্রকল্প চালানোর জন্য বুল শুরু করেন অস্ত্র বিক্রি। আর সেই বিক্রিত অর্থ থেকে তিনি চালাতে থাকেন তা সুপারগান প্রকল্প। স্পেস রিসার্চ করপোরেশন নামে একটি কোম্পানি খুলে বসেন তিনি এবং সেখান থেকেই তিনি সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে অস্ত্র বিক্রি করেন। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি নীতিমালা ভঙ্গ করায় বুলকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ছয়মাস তাকে মার্কিন কারাগারে কাটাতে হয়। মুক্তি পাবার পর তিনি আবারও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেই অস্ত্র বিক্রি করতে শুরু করেন এবং এবারে তাকে এই অস্ত্র বিক্রির জন্য ৫৫হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। শেষমেষ কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি ব্রাসেলস, বেলজিয়ামে চলে যান এবং সেখান থেকেই ইউরোপের দেশগুলোতে অস্ত্র ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময়টায় বুল ক্রমশ পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন তিনি।
১৯৮১ সালে ইরাকি সরকার বুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অস্ত্র নির্মানের জন্য। কারণ সাদ্দাম হুসেইন চাচ্ছিলেন বুলের বানানো অস্ত্র দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ওই সময় সাদ্দাম হুসেইন ছিলেন ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। বুল সাদ্দাম হুসেইনকে তার পরিকল্পনা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন নিশ্চিতভাবেই। অধ্যাপক হলের মতে, বুল বিশেষ করে সাদ্দাম হুসেইনের উপর আগ্রহ বোধ করেছিলেন কারণ সাদ্দামেরও সমান আগ্রহ ছিল আর্টিলারি নিয়ে। তৎকালীন সময়ে সাদ্দাম হুসেইন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অতটা হুমকিস্বরুপ না থাকলেও আরব বিশ্বের নেতার হবার বাসনা তার বেশ ভালো করেই ছিল। আরব বিশ্বের নেতা হয়ে তিনি তার সমরাস্ত্র ক্ষমতা দেখাতে চেয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে। এমনকি সাদ্দাম হুসেইন কক্ষপথে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনেরও চিন্তা করেছিলেন।
শেষমেষ ১৯৮৮ সালে ইরাকি সরকার বুলকে ২৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয় ব্যবিলন প্রকল্পের জন্য। বুলের জন্য এটাই ছিল প্রথম পরিপূর্ণ সুপারগান প্রকল্প। ব্যবিলন প্রকল্প থেকে মোট তিনটি সুপারগান তৈরি করা হয়েছিল। বন্দুক তিনটির মধ্যে দুটি তৈরি করা হয় এক হাজার মিলিমিটার ক্যালিবারের বন্দুক। ও অন্যটি তৈরি করা হয় ৩৫০ মিলিমিটারের, যার নাম দেয়া হয়েছিল বেবি ব্যবিলন। ১৫৬ মিটারের বিশাল আয়তনের ব্যবিলন বন্দুকটির ওজন প্রায় দেড়হাজার টনেরও বেশি। সহজে বহনযোগ্য ছিল না বলে একটি পাহাড়ের ঢালে ৪৫ ডিগ্রি কোন করে রাখা হতো বন্দুকটিকে। হিসেব অনুযায়ী এই বন্দুকটি ৬০০কেজি ওজনের গুলি প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত ছুড়তে পারতো। আর এই এক হাজার কিলোমিটারের মধ্যে শুধু কুয়েতই ছিল না, ইরানও ছিল এর আওতায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বুলের তৈরি করা ওই সুপারগানের অনেক ত্রুটি ছিল। যেগুলো তৎকালীন সময়ে অতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা এক রিপোর্টে জানিয়েছিল যে, ওই সুপারগান দিয়ে মহাকাশে স্যাটেলাইট নিক্ষেপে প্রতি কিলোগ্রামে ব্যয় হবে এক হাজার সাতশত সাতাশ ডলার। অন্যদিকে বর্তমান প্রযুক্তিতে প্রতি কিলোগ্রাম পাঠাতে ব্যয় হয় বাইশ হাজার ডলার। বিগ ব্যবিলনের বিভিন্ন অংশ তৈরি করা হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড এবং ইতালিতে। এমনি খোদ যুক্তরাজ্য থেকেও তৈরি করা হয়েছিল এর উল্লেখযোগ্য অংশ, কারণ যুক্তরাজ্যের ফোর্গমাস্টাররা পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্টিল তৈরি করে থাকে।
যাই হোক, সেই বিগ ব্যবিলন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রয়েছে। ইরাকে আক্রমনের এক পর্যায়ে যুক্তরাজ্য এই বন্দুকটিকে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। তবে বিজ্ঞানী বুলের ভাগ্য অতটা ভালো ছিল না। ১৯৯০ সালে ব্রাসেলসে তার নিজের বাসভবনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। বুলকে হত্যা করা কয়েক মাসে আগে তার বাসভবনে আরও একবার হামলা চালানো হয়েছিল কিন্তু তখন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইতিহাসে আজও বুলের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং কোন দেশ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাও জানা যায়নি।
মন্তব্য চালু নেই