সব ছেলেবন্ধুর প্রতি খোলা চিঠি

‘আমি জানি, রাস্তায় মেয়েদের দেখে শিস দিয়ে ওঠা পুরুষ তোমরা নও। পুরুষ হওয়ার কারণে তোমাদের খারাপ লাগুক, সেই চেষ্টাও আমি করছি না। কিন্তু আমি তোমাদের জানাতে চাই, নারী হয়ে থাকতে কেমন লাগে।’ লেখক-সাংবাদিক এস্তেলে তাঙ একটা খোলা চিঠিতে এভাবেই নিজের মনের কথা খুলে বলেছেন সব ছেলেবন্ধুর উদ্দেশে। এস্তেলে একসময় ছিলেন মেলবোর্নে, এখন থাকেন নিউইয়র্কে। এ দুই নগর তো বটেই, দুনিয়াজুড়েই নারীরা চলতে-ফিরতে দিনে-রাতে নিত্যই যৌন হয়রানির শিকার হন। একজন নারী এসব পরিস্থিতিতে কী ভাবেন, কীভাবে সামলান নিজেকে। নিজের এবং বন্ধুদের অভিজ্ঞতা থেকে এ নিয়ে লিখেছেন তিনি। চিঠিটা শুক্রবার দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য এস্তেলে তাঙের খোলা চিঠির ভাষান্তর:

আমার সব ছেলেবন্ধুর প্রতি

আজকে আমার কী হয়েছে, সে বিষয়ে তোমাদের বলতে চাই।

আমি হেঁটে হেঁটে জিমে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে চড়া একটা লোক পাশে এসে বলল, ‘বেবি, আমি কি তোমার নিতম্বে হাত বোলাতে পারি?’ নিউইয়র্কে যে এলাকায় থাকি, সেখানে এ ধরনের আচরণে আমি অভ্যস্ত, তাই সাধারণত আমি এসবে নীরবই থাকি। বিশ্বাস করো, যদি এমন কিছু বলা প্রত্যেক লোকের সঙ্গেই আমি বচসা করতাম, তাহলে তা করতে করতেই দিন পার হয়ে যেত আর প্রতিটি দিনই হতো আরও বিরক্তিকর। তাই আমি হাঁটা চালিয়ে যাই। লোকটা আবারও একই কথা বলল। কিন্তু আমি কী করব বা আদৌ কিছু করাটা ঠিক হবে কি না, তা ভেবে ওঠার আগেই আমি আমার নিতম্বে লোকটার হাতের স্পর্শ টের পেলাম।

হ্যাঁ, লোকটা বাইকে করেই কাছে চলে এসেছিল, যাতে সে এটা করতে পারে। তারপর আমি কী করব ভেবে ওঠার আগেই বাইকে টান দিয়ে চলে যায় লোকটা।

আমার খুব রাগ হয়েছিল এবং এখনো খুব রেগে আছি। ওই সময় আমার খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আরও ভয়াবহ কিছু ঘটেনি ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। আকস্মিক ভয়টা কেটে যাওয়ার পরপরই আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম, আমার আদৌ জিমে যাওয়া উচিত কি না। আমার হয়তো বাড়িতেই থাকা উচিত এবং কখনোই বাড়ির বাইরে বেরোনো উচিত নয়। ওটাই হয়তো নিরাপদ। অর্থহীন, তাই না?

মেলবোর্ন থেকে নিউইয়র্কে চলে আসার পর থেকেই আমি পথে-ঘাটে এত বেশি আর এত নিয়মিতভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি যে এটা বিশ্বাস করা সত্যিই কষ্টকর। আমি ভাবতে শুরু করলাম, এই শহরের জনসংখ্যা অনেক বেশি, হয়তো এই কারণেই হয়রানির পরিমাণও বেশি, এমনটা হতেই পারে। আমি বরং ভাবতে শুরু করলাম (এবং এখনো ভাবি) যে, পথে-ঘাটে কেউ শিস দিয়ে উঠল বা খিস্তি-খেউড় করতে শুরু করল…গড়পড়তায় বিষয়টা এই সীমার মধ্যেই থাকছে। আমাকে এর চেয়ে মারাত্মক হয়রানির শিকার খুব একটা হতে হচ্ছে না, এটাই তো শুকরিয়া! এ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি কিছু একটা করে বসতেও চাইনি আমি। আর মনে হচ্ছিল, এসব সামলে চলাটা হয়তো খুব কঠিন হবে না।

কিন্তু একসময় আমি লক্ষ করলাম, এই হয়রানি প্রতিদিনই ঘটছে। এটা এমনভাবে আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে যে যখন কোনো পুরুষ আমার দিকে তাকায়, আমি তা অনুমান করতে পারি এবং অস্বস্তিটা টের পাই। আমি হেঁটে যাওয়ার সময় যে পুরুষেরা আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, আমি মনের গহিন ভেতর থেকে তাদের প্রত্যেকের জন্য দোয়া করি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় খুব সাধারণ পোশাক-আশাকে বের হওয়া, মেকআপ না করা, সব করে দেখেছি আমি; লাভ হয় না। বিনা বাক্য ব্যয়ে বলব যে অলক্ষ্যে চলাফেরা করার জন্য আমাকেই আমার আচার-আচরণ পাল্টাতে হবে—এমন ধারণার পক্ষের লোক আর যে-ই হোক আমি নই। এমনকি, এভাবে চেষ্টা করে দেখব ভাবতেও আমার ঘেন্না হতো। কিন্তু তাও করে দেখেছি। এসবে কোনোই লাভ নেই।

আর সাম্প্রতিক সব ভয়াবহ ঘটনায় মনে হচ্ছে, আমি যেসব হয়রানির শিকার হচ্ছি, তা আসলে বিশাল একটা ছুরির একটা ভোঁতা ও স্থির অংশ মাত্র। ছুরিটার আরও ভয়াবহ ব্যবহার আছে, ছুরিটা আরও মারাত্মক ধ্বংসাত্মক। তোমরা হয়তো এত দিনে ক্যালিফোর্নিয়ার ২২ বছরের তরুণ এলিয়ট রজারের কথা জানো, যে ছেলেটা সাতজনকে গুলি করে খুন করার পর নিজেও আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা ঘটানোর আগে সে একটা ভিডিও পোস্ট করে এবং একটা ইশতেহার প্রকাশ করে। যেখানে নারীদের প্রতি তার ঘৃণা এবং পরিকল্পিত জিঘাংসার বিশদ বর্ণনা আছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই আরেক লোক তিন নারীকে খুন করেছে। কারণ, ওই নারীরা তার এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে

শুতে রাজি হয়নি। আমি আতঙ্কিত। প্রতিবারই যখন কোনো লোক রাস্তায় আমাকে দেখে শিস দেয় বা ফিসফিসিয়ে বলে, আমি খুবই আবেদনময়ী, ততবারই আমি তাকে এড়িয়ে যাই। এর মানে কি এও না যে আমি তাকে প্রত্যাখ্যান করছি? আর এ জন্য আমিও কি একদিন ওই ধরনের বিপদে পড়তে পারি?

আমি বুঝতে পারি এসবে হয়তো তোমাদের কিছু আসে-যায় না। তোমরা হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় নিজের বাড়িতে আছ। আমার জীবনের একেকটা দিন কীভাবে কাটে, তা তোমাদের জানার কোনোই কারণ নেই।

কিন্তু আমি চাই তোমরা তা জানো। কয়েক মাস আগে আমি আমার ছেলেবন্ধুটাকে এসব বলতাম না। ভাবতাম খামাখাই তাকে এসব বলা মানে যেন দেখো কত কত পুরুষেরা আমাকে চায়—এমন বলা! কিন্তু এখন আমি ওকে এগুলো বলতে শুরু করেছি। আসলে আমি প্রতিটি ঘটনাই তাকে বলতে চাই। ওই সব পুরুষের কাছে আমি কতটা কাম্য, তা বোঝাতে কিংবা আমার জন্য কেউ ভাবুক, সে জন্য নয়। আমি চাই সে জানুক, তোমরা জানো। সবাই জানুক যে নারীর প্রতি সহিংসতা বাস্তবেই ঘটছে এবং নারীরা প্রতিদিনই এর শিকার হচ্ছে।

আমি চাই না যে তোমরা ভাবো এটা এমন কিছু, যা শুধু আমেরিকাতেই ঘটে। অবশ্যই এটা এখানে নিত্যদিনের ঘটনা, কিন্তু আমার শহর মেলবোর্নে আমার মেয়েবন্ধুরাও এই হয়রানির শিকার হচ্ছে।

আমার এমন অভিজ্ঞতাও আছে যে একটা লোক চলন্ত ট্রেনের মধ্যেই আমার গায়ে হাত দিতে শুরু করেছিল। আমি ফেসবুকে আমার মেয়েবন্ধুদের একটা গ্রুপে ওই কথা শেয়ার করে জানতে পারলাম, এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি একাই হইনি, অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে। লন্ডনে আমার পরিচিত এক মেয়ে আমাকে বলল, ওর জীবনেও প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। সকালে দৌড়োনোর সময় একটা লোক পেছন থেকে এসে ওর নিতম্বে থাপ্পড় মেরে চলে যায়। মেয়েটি জানায়, ‘এখনো আমার গায়ে জ্বালা ধরে যায় আর তোমার কথা শুনেও আমার একই অনুভূতি হচ্ছে।’ পোল্যান্ডের একটা মেয়েকে আমি চিনি। জিম থেকে ফেরার সময় এক মাতাল তার ওপর হামলে পড়েছিল। মেয়েটি আমাকে বলেছে, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমি বুঝতে পারছিলাম যে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’

লেখিকা দুর্গা চিউ-বোসের একটা ইনস্টাগ্রাম পোস্ট দেখে আমি ভীষণ নাড়া খেয়েছিলাম। এখনো তা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তিনি এবং তাঁর কিছু মেয়েবন্ধু ফেসবুকে প্রতিদিন ঘরে ফেরার একটা ‘চেক ইন’ পোস্ট দেন। সেই পোস্টের একটা স্ক্রিন শট ছিল ওটা। বাড়ি ফিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই নারীরা একে অপরকে শেষ যে টেক্সট করে, তাতে ‘গুডবাই’ বা ‘গুডনাইট’-জাতীয় কিছু থাকে না। তাতে লেখা থাকে—‘বাড়িতে! তুমি?’ কিংবা ‘বাড়ি ফেরা নিরাপদ হোক’।

এটা না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই যে আমাদের নারীদের এসব পরিস্থিতিতে কতটা দায়িত্বের বোঝা বহন করে চলতে হয়। আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চাই, কিন্তু আঘাতের শিকার হতে চাই না।

সত্যি বলতে কি, আজকে কী হয়ে গেছে, তা নিয়ে খুব বেশি সময় নষ্ট করার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু এই ঘটনার আরেকটা দিকও তো আছে। যদি আইনের কথা বলি, অস্ট্রেলিয়ায় এসব ঘটনা বেআইনি। এগুলো নিপীড়ন, কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের বলপ্রয়োগের মতোই নির্যাতন এসব।

যাক গে, আমার চিঠি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি উল্টাপাল্টা হয়ে আছি। আমি জানি, তোমরা রাস্তায় মেয়েমানুষ দেখে শিস দিয়ে ওঠা পুরুষ মানুষ নও। পুরুষ হওয়ায় তোমাদের খারাপ লাগুক, সেই চেষ্টাও আমি করছি না। বিশ্বাস করো, আমি জানি সবখানেই অনেক ভালো আর চমত্কার পুরুষ আছে। কিন্তু আমার মনে হলো আমি তোমাদের জানাতে চাই যে নারী হয়ে থাকতে কেমন লাগে। আর আমি যখন এসব নিয়ে কথা বলছি, তখন তোমাদের এটাও জানানো দরকার যে কেন আমি তোমাদের ধর্ষণবিষয়ক কৌতুকের আনন্দ মাটি করে দিই (দুঃখিত, ওসব কৌতুকে আমি কখনোই হাসতে পারব না)। আর আমি তোমাদের আমার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দল হতেও বলছি না কিংবা সে রকম অন্য কিছুও বলছি না।

আমি আসলে কী চাই? আমি নিশ্চিত করে জানি না। আমি কি চাই যে তোমরা চোখ-কান খোলা রাখো, (টুইটারে শুরু হওয়া নারী নির্যাতনবিরোধী প্রচারাভিযান) ‘ইয়েস অল উইমেন’ হ্যাশট্যাগে কী লেখা থাকে, সেগুলো পড়ো, প্রতিদিনই নারীদের কত কিছু সামলাতে হয়, সেগুলো জানো। আর যারা বলে, এলিয়ট রজারের অপরাধটা নারীবিদ্বেষী ছিল না, তাদের কথায় তোমরা কান না দাও। আর দয়া করে তোমরা ধর্ষণ নিয়ে কোনো কৌতুক করো না।
আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, আমি শুধু চাই, তোমরা এসব জানো।

ভালোবাসা

এস্তেলে



মন্তব্য চালু নেই