সত্য ঘটনা প্রমাণ করতে গিয়ে অন্ধ
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফলের ব্যবসা করেন গোপালগঞ্জের চুন্নু মুন্সী। মঙ্গলবার মুকসেদপুরের বামনডাঙ্গা খেয়াঘাটের কাছে চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার চোখ দুটি নষ্ট করে দেয় প্রতিপক্ষের লোকজন। এখন তার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে।
পুরো ঘটনা নিয়ে শুক্রবার কথা বলেন ৪৭ বছর বয়সী চুন্নু মুন্সী। তিনি বলেন, ‘সত্য ঘটনা প্রমাণ করতে গেছিলাম। শিশু হত্যা মামলায় নিরপরাধ লোককে ফাঁসানোর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে গেছিলাম। এজন্য আমারে ধইরা নিয়া চোখ দুইটা অন্ধ কইরা দিছে। হাত-পা কাইটা দিছে। আমি তাগোর বিচার চাই।’
চুন্নু মুন্সীর পরিবার জানায়, প্রতিবেশী চাচা আওলাদ শেখের সঙ্গে বিরোধের জেরে তার ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়। গলা কেটে হত্যার চেষ্টা ছাড়াও তাকে পিটিয়ে পা ভেঙে দেয়া হয়। কাটা হয় হাত ও পায়ের রগ। ডাক্তার মোস্তফা কামাল মজুমদারের অধীনে এখন তার চিকিৎসা চলছে। বৃহস্পতিবার তার চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন কিনা এখনও নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা।
চুন্নু মুন্সীর একমাত্র ছেলে আহাদ মুন্সী বলেন, ‘আমাকে বললে আমি মা-বাবাকে নিয়ে বাড়ি থেকে চইলা যাইতাম। কিন্তু তারা কেন আমার বাবার সঙ্গে এ নিষ্ঠুর আচরণ করল।’ হাসপাতালে বাবার পাশে আহাদ আরও জানান, প্রতিপক্ষ আওলাদ শেখ ও তার লোকজনের ভয়ানক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তার বাবা।
মালেক মুন্সীর ছেলে চুন্নু মুন্সী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, মুকসেদপুরে ২০০৭ সালে ওয়াসিম নামে এক শিশুর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাদের প্রতিবেশী আওলাদ শেখের প্রভাবে তার আত্মীয়দের নামে মামলা হয়। অথচ মামলার আসামিরা ওই সময় ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ছিলেন। তারা কেউ বাড়িতে ছিলেন না। মামলা হওয়ার পর পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। কয়েক মাস আগে সেই মামলায় চুন্ন মুন্সীর আত্মীয়রা নির্দোষ প্রমাণিত হন। পরে পুলিশি তদন্তে জানা যায়, শিশু ওয়াসিম হত্যার সঙ্গে আওলাদ শেখের ঘনিষ্ঠ লোকজন জড়িত। ওই মামলায় পুলিশ মিন্টু, জিমফু, তার ভাই রিমাজ ও সম্রাটসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। রিমাজ ও সম্রাটসহ কয়েকজন ওয়াসিমকে খুনের বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মূলত শিশুটির চোখ ও কিডনি নেয়ার জন্যই পাট ক্ষেতে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু মামলায় ফাঁসানো হয় চুন্নু মুন্সীর পরিবারের লোকজনকে।
চুন্নু মুন্সীর আত্মীয়রা জানান, জিমফু ও রিমাজ আপন ভাই। কয়েক মাস আগে তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধের জেরে জিমফু ওই হত্যাকাণ্ডের কথা ফাঁস করে দেয়। এরপরই পুলিশ জিমফু, রিমাজ ও সম্রাটকে গ্রেফতার করে। পরে জিমফুকে করা হয় মামলার সাক্ষী।
চুন্নু মুন্সীর ছেলে আহাদ আরও জানান, ঢাকার কারওয়ান বাজারে তার বাবার ফলের আড়ত রয়েছে। তিনি নিজেও ওই আড়তে কাজ করেন। কয়েকদিন আগে তার বাবা গ্রামের বাড়িতে যান।
সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পায় জিমফু। সে ধারণা করে, বাবা তাকে (জিমফু) জেলে ঢুকিয়েছেন। এ কারণে তার বাবাকে মেরে ফেলার জন্য হামলা করে।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ ও মুন্সী পরিবারের মধ্যে বিরোধ বহুদিনের পুরনো। জমিজমা নিয়ে এ বিরোধের সূত্রপাত। শিশু ওয়াসিম হত্যাকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া চুন্নু মুন্সী আরও জানান, জিমফুর নেতৃত্বে আফরান, শাহদাত, আফসার, নিজামুল, নয়ন, সুমন, মনির ও কারী মোল্লা তার ওপর হামলা করে। তার বুকের ওপর বসে চাকু চোখে ঢুকিয়ে দেয়। হাত-পা কেটে দেয়। চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক মোস্তফা কামাল মজুমদার জানান, চুন্নু মুন্সীর বাঁ চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। ডান চোখও ক্ষতিগ্রস্ত। তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আহত স্বামীর পাশে বসা স্ত্রী পেয়ারী বেগম। তিনি চোখের পানি ছেড়ে বলেন, বিনা দোষে তার স্বামীকে নির্মম এ হামলার শিকার হতে হয়েছে। স্বামী অন্ধ হয়ে গেলে তারা কিভাবে বাঁচবেন, প্রশ্ন করেন পেয়ারী বেগম।
মুকসেদপুর থানার ওসি আজিজুর রহমান জানান, পারিবারিক বিরোধ ও প্রতিহিংসা থেকে চুন্নু মুন্সীর ওপর হামলা হয়েছে। হামলার ঘটনায় বুধবার রাতে ৩২ জনকে আসামি করে মামলা হয়। আসামিদের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান খান বলেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুর্বৃত্তরা চুন্নু মুন্সীর ওপর হামলা চালিয়েছে। হামলার পর তারা সবাই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। হামলার ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে।-যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই