লেবু বিক্রেতা থেকে প্রতাপশালী সুলতান!

তুরস্কের রাস্তায় লেবু বিক্রি করতেন তিনি। বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের সদস্য। এখন তিনি তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তিনি রিসেপ তায়েপ এরদোগান।

৬৩ বছর বয়সী এই মানুষটি এবার তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতা পাকাপোক্তে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।

রোববার তুরস্কের ঐতিহাসিক গণভোটে জনগণ তার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। এর ফলে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে দেশটি প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।

গণভোটের এ রায়ে তুরস্কে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।

রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সি জানায়, ৯৮ ভাগের বেশি ভোট গণনার পর দেখা যায়, সরকারের প্রস্তাবিত সংবিধান পরিবর্তন তথা ‘হ্যাঁ’ এর পক্ষে প্রায় ৫১.৩৬ ভাগ ভোট পড়েছে। অন্যদিকে না ভোট পড়েছে ৪৮.৬৪ ভাগ।

নির্বাচনের এ ফল প্রত্যাশিতই ছিল। ২০০৩ সাল থেকে দল ক্ষমতায় আসার পর এরদোগান ১১টি নির্বাচনে- পাঁচটি সংসদ নির্বাচন, দুটি গণভোট, তিনটি স্থানীয় নির্বাচন ও একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করেছেন এবং প্রতিটিতেই জয়ী হয়েছেন।

এর আগে এরদোগানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ২০১৫ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ১৩ বছরের শাসন প্রলম্বিত করার সুযোগ পায়।অবশ্য গত বছর সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রুখে দিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান এরদোগান।

বলা হচ্ছে, তুমুল জনপ্রিয়তার এ সুযোগ নিয়ে তুর্কিদের ওপর প্রতাপশালী নয়া সুলতান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন এরদোগান।

এবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মার্কিন স্টাইলের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তিনি। এভাবে গণতান্ত্রিক উপায়েই ‘এক ব্যক্তির শাসন’ প্রতিষ্ঠায় উচ্চাভিলাষী এরদোগান।

১৯৫৪ সালে তুরস্কের কাসিমপাসায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশব কেটেছে কৃষ্ণসাগরের পাড়ে। ১৩ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলে আসেন। সেখানে রাস্তায় বিক্রি করতেন লেবু, তিল ও ঝুটি। পরবর্তী সময় পড়ালেখা করেছেন ব্যবসায় প্রশাসনে। জড়িয়ে পড়েন ইসলামী আন্দোলনে।

১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। দেড় কোটি মানুষের শহর ইস্তাম্বুলে তখন তিনি যানজট ও বায়ুদূষণ রোধ করে নগরের চেহারা পাল্টে দেন।

তুরস্কে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তিনি বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে একটি ধর্মীয় কবিতা আবৃত্তির কারণে চার বছরের জেল হয় তার। কবিতাটি ছিল- ‘মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক।’

এরদোগানের দীর্ঘদিনের মিত্র আবদুল্লাহ গুল ও অন্যদের সঙ্গে মিলে ২০০১ সালে একেপি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সাল থেকে এ দলটি প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভ করে আসছে।

জেল খাটার অতীত থাকায় প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি তিনি। পার্লামেন্টে নতুন আইন পাসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন।

লম্বা স্লিম মধ্যবয়স্ক এরদোগান রাজনীতিতে এক ভিন্নধর্মী ইমেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন কোনো মুসলিম দেশে প্রেসিডেনসিয়াল সফরে গেলেন, তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম পাঁচ মিত্র দেশের অন্যতম বলে উল্লেখ করলেন।

এরদোগানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘একজন নেতা কীভাবে একইসঙ্গে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এরদোগান।’

রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রকে সমন্বিত করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি রোল মডেল সৃষ্টি করেছেন। কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের জনগণের ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনা মুছে ফেলেছিলেন।

এরদোগান সেই ক্ষত সারিয়ে বলেছেন, ধর্ম পালনে কাউকে বাধ্য যেমন করবেন না, তেমনি ধর্ম পালনে কেউ যেন বাধা না দিতে পারে সে ব্যবস্থা তিনি করবেন।

তবে সমালোচকরা বলছেন, অনেক আগেই তিনি গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে এসেছেন। ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে ১১৫০ রুমবিশিষ্ট বিলাসবহুল প্রেসিডেন্ট প্যালেস বানানো তার কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতালিপ্সার দৃষ্টান্ত।

ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষক আসলি আইদিনতাসবাস বলেন, ‘নির্বাচনে একেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা এটাই নির্দেশ করে যে, জনগণ এরদোগানের কর্তৃত্ববাদী শাসন অনুমোদন করেছেন। এখন তিনি পুতিন স্টাইলে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করবেন।’

তুর্কিদের একাংশ এরদোগানকে ‘বুয়ুক উস্তা’ বা ‘বড় মাস্টার’ বলে থাকেন। তিনি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন সুলতান হিসেবে। কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘এরদোগান দ্য লাস্ট ডিক্টেটর’।

রোববার হ্যাঁ ভোট জয়ী হওয়ায় তুরস্কের বর্তমান সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হবেন। ২০২৯ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তিনি।

ফলে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর এরদোগানই হতে যাচ্ছেন তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী নেতা।

তবে এ গণভোটকে কেন্দ্র করে দেশটির মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এরদোগান সমর্থকরা বলছেন, চলতি সংবিধান আরও উন্নত করার জন্য এ পরিবর্তন জরুরি। অপরদিকে বিরোধীরা বলছে, এ পদক্ষেপ দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘হ্যাঁ’ জয়ী হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইইউয়ের সঙ্গে এক চুক্তির পর সিরিয়া ও ইরাক থেকে ইউরোপ অভিমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্রোতের লাগাম টেনে ধরে তুরস্ক।

সম্প্রতি গণভোটের প্রচারণা নিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নাজুক হওয়ার পর ওই চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি দেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ধারণা করা হচ্ছে, গণভোটে জয়ী হোয়ার ফলে তিনি ওই হুমকি বাস্তবায়ন করতে পারেন।

(২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংযোজনসহ)



মন্তব্য চালু নেই