রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যার প্রমাণ মিলেছে

মিয়ানমার সরকার যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছিল তার ‘জোরালো প্রমাণ’ খুঁজে পেয়েছে আল জাজিরার তদন্ত দল। ইয়েল ইউনিভার্সিটির ল স্কুলের এক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

সোমবার ‘ Exclusive: ‘Strong evidence’ of genocide in Myanmar’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই দাবি করেছে আল জাজিরা।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের লয়েনস্টেইন ক্লিনিক মিয়ানমারের ওপর দীর্ঘ আট মাস ধরে গবেষণা চালানোর পর ওই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এক বিবৃতিতে ওই ক্লিনিক জানায়, রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যা চালানো হয়েছে এবং এতে ইন্ধন জুগিয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদরাই। ‘আমরা মনে করি তারা যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছেন তাতে গণহত্যা এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না।’

মিয়ানমার সরকারের ইন্ধনেই যে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালানো হয়েছিল মানবাধিকার গোষ্ঠী ফোর্টি রাইটস এবং আল জাজিরার তদন্ত দলের অনুসন্ধানেও তা স্পষ্ট। তাদের দাবি, স্থানীয় নেতারা বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সচেষ্ট ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখেছেন। এছাড়া ওই নেতারা মুসলিম নিধনের জন্য চরমপন্থি বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দেশটিতে ৮ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনের আগে আল জাজিরার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ওই প্রতিবেদনে আরো অভিযোগ করা হয়েছে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের দেশছাড়া করতে ক্ষমতাসীন এবং সেনা সমর্থিত উইউনিয়ন সোলিডারিটি এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে আল জাজিরা এ বিষয়ে মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এবং মুখপাত্রদের মন্তব্য করার অনুরোধ জানালেও তারা এতে রাজি হননি।

গণহত্যা এজেন্ডা

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ (আইএসসিএল ) গোষ্টীর পরিচালক পেনি গ্রিন বলেন,‘ইউএসডিপি দলের নেতা এবং প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইন নিজে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃন্য বক্তব্য রেখেছেন যাতে মিয়ানমারের মুসলিমদের  সংখ্যা হ্রাস, উচ্ছেদ এবং পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়।’

আইএসসিএল আরো বলছে, ২০১২ সালে রাখাইনে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ এবং সংখ্রালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল তা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। ওই দাঙ্গায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছিলেন যাদের সিংহভাগই ছিল রোহিঙ্গা। সেসময় গৃহহীন হয়েছিলেন আরো হাজার হাজার মানুষ। যদিও অধ্যাপক গ্রিন একে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে স্বীকার করছেন না। তার ভাষায়,‘এটি কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত সহিংসতা। রাখাইন মুসলিমদের ওপর হামলা চালানোর জন্য তখন বাসে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বৌদ্ধদের নিয়ে আসা হয়েছিল। শুধু তাই নয়। এসব হামলাকারীদের জন্য খাবার দাবার সরবরাহ ও মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেউ না কেউ এসবের ব্যয় বহন করেছিলেন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোটা আগ্রাসী পরিকল্পনাটি রচিত হয়েছিল।’

মিয়ানমারের সাবেক জাতিসংঘ দূত থমাস ওজিয়া কুইনটান এ সহিংসতার জন্য প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইন এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের ওপর তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ঘৃণাই যার মূল উপজীব্য

এটি প্রমাণিত যে, গণহত্যা এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গা ছড়াতে কলকাঠি নেড়েছিল মিয়ানমার সরকার। এই তথ্যের ওপর এক সামরিক কর্মকর্তার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নথি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে আল জাজিরা। এতে দেখা যায়, মুসলিমদের মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর জন্য বিপজ্জনক উল্লেখ করে নানা ধরনের ঘৃণ্য বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।

তাদের তদন্তে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষ ছড়াতে মিয়ানমার সরকার যে  ঘৃণ্য বক্তব্য রেখে তাও প্রমাণিত। দেশটির এক প্রাক্তন সংসদ সদস্য সেনাবাহিনী কর্তৃক মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রমাণ দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী সদস্য আল জাজিরাকে বলেছেন,‘পর্দার আড়াল থেকে আসল কলকাঠি নেড়েছিল সেনাবাহিনী। যদিও তারা এই দাঙ্গার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল না। তারা গোপনে ধর্মান্ধ বৌদ্ধ নেতাদের অর্থ সরবরাহ করত।’

এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে সরকার ও সেনাবাহিনী এই মুসলিম বিদ্বেষ কেন ছড়িয়েছিলেন? এ প্রসঙ্গে আল জাজিরার বক্তব্য হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মিয়ানমারের সেনাশাসনের বিরোধিতা থেকে নিবৃত রাখতেই এই ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছিল তারা। ২০০৭ সালে সামরিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল গেরুয়া বিদ্রোহ। এরপরই তারা মুসলিম-বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নীলনকশা রচনা করে।

এ প্রসঙ্গে ফোর্টি রাইটস গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট স্মিথ বলেন,‘রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একাধিক গণহত্যার প্রমাণ মিলেছে। যার কয়েকটির সঙ্গে দেশের ক্ষমতাসীন লোকজন জড়িত ছিল।’

নাগরিক অধিকার বঞ্চিত মুসলিমরা

নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ইউএসডিপি এবং অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি (এনএলডি) অংশ নিচ্ছে। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে মিয়ানমারের জন্য এ নির্বাচন কঠিন পরীক্ষা হিসেবেই বিবেচিত হতে যাচ্ছে। দেশটিতে ২০১০ সাল থেকেই বদলাতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। তবে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট সরকারের ছত্রছায়ায় ২০১১ সাল থেকেই কট্টর বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো সুবিধা পেয়ে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের রাজনীতিতে তাদের সীমাহীন প্রভাব লক্ষ্যনীয়। হয়তোবা এ কারণেই এ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেনি রাখাইন মুসলিমরা। শুধু কি তাই! চলতি বছরের গোড়ার দিকে মিয়ানমার সরকার লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ায় এ জনগোষ্ঠীর অনেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ পাচ্ছেন না।



মন্তব্য চালু নেই