রোহিঙ্গা ইস্যুতে সূচির নিরবতার নেপথ্যে
নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটু, শিরিন এবাদি থেকে শুরু করে বৌদ্ধধর্মীয় নেতা দালাই লামা পর্যন্ত যখন রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন মিয়ানমারের নোবেলজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সূচির নিরবতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তবে ভোটের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া সূচির কাছে এ ধরনের আচরণ অতটা বিস্ময়ের নয়।
মিয়ানমারে অনেক দিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে ২০১২ সালে। ওই সময় উগ্রপন্থী কিছু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের হামলার শিকার হয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরা। হাজারো রোহিঙ্গার বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হতাহত হয় হাজারো মানুষ ও গৃহহীন হয় প্রায় দেড় লাখ। ওই আগ্রাসনে সরকারেরও ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই আগ্রাসনের পর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংস্থা মিয়ানমার সরকারের সমালোচনা করে। সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গও। তখনও অনেকে আশা করেছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী সূচি অন্তত রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে বিবৃতি দেবেন। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই চেপে যান তিনি।
ওই সময় তিব্বতের বৌদ্ধধর্মীয় নেতা দালাই লামাও বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করেন। তখন সূচি তাকে সমস্যা অনুধাবনের কথা জানালেও পরবর্তী সময়ে তা রোধে কোনো ধরনের ভূমিকা নেননি।
সম্প্রতি আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরে মানবপাচারকারীদের নৌকায় ভাসমান অবস্থায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশীর সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বিদেশ গমনেচ্ছুদের নির্যাতন শিবির এবং লাশ পাওয়ার ঘটনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবারও জনসম্মুখে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বৈঠকও হয়েছে।
অন্যান্যবারের মতো এবারও মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান না করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সূচিও বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন সরকারের হাতেই!
গত ১৯ মে এক বক্তব্যে সূচি বলেন, ‘সরকারই এ সমস্যার সমাধান করবে।’
সূচির এ বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন বিশ্বনেতারা। দালাই লামা তাকে এ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে আবারও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো অত্যাচার ‘গণহত্যার চেয়ে কম নয়’ উল্লেখ করে বিষয়টির সমাধান চেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটু, ইরানের শিরিন এবাদি ও পূর্ব তিমুরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তার মেতা নোবেলজয়ীরাও।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এত কিছুর পরও সূচির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নেই। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনীতি ঘাঁটলে অবশ্য বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর দেশটিতে সামরিক জান্তারা শাসন চালিয়ে আসছে। এর মাঝে গণতন্ত্রের দাবিত আন্দোলন চালিয়ে বন্দী হন সূচি।
১৫ বছর বন্দী থাকার পর ২০১০ সালে তাকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয় বর্তমান থেইন সরকার। ছাড়া পাওয়ার পরপরই নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু করেন সূচি। সরাসরি ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলেও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’কে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সামরিক সরকার।
দেশটিতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সূচি ও তার দলের কাছে বর্তমানে ভোটই মুখ্য। দেশটিতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ভোটার হওয়ার অধিকার পায়নি। তাদেরকে দেশটির নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না জান্তা সরকার। সরকারের ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গারা বাঙালি ও বাংলাদেশের নাগরিক। এমনকি দেশটির আদমশুমারিতেও রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভোটার না হওয়ায় দেশটিতে বাস করা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই সূচি ও তার দলের। সুতরাং, তাদের (রোহিঙ্গা) অবস্থার যে কোনো পরিবর্তনে সূচির কিছু যায় আসে না। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে মন্তব্য করে সরকারের রোষানলে পড়তে চান না তিনি।
শুধু সরকারই নয়, দেশটির বৌদ্ধদের মধ্যে উগ্রপন্থীরাও সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসবাসের বিরোধী। সূচির যে কোনো মন্তব্য তাদের রুষ্ট করবে। যার প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে বা সূচির দল কতটা সাফল্য অর্জন করতে পারবে তা এখন মুখ্য নয়। নির্বাচনে জয়লাভের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করাই এখন সূচি ও তার দলের প্রধান কাজ। এ অবস্থায় ভোটের অধিকারহীন রোহিঙ্গারা সাগরে ভাসলেই কী আর গণহত্যার শিকার হলেই বা কী আসে যায়?
মন্তব্য চালু নেই