রাতের রাজপথে ভয়ঙ্কর ‘গাড়ি পার্টি’

প্রাইভেটকার বা মাইক্রেবাস নিয়ে রাতের রাজপথে নেমে পড়ে তারা। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই এরা ছিনতাইকারী। কখনো যাত্রী বহনের ছলে টার্গেট ব্যক্তিকে তোলে গাড়িতে। আবার কখনো ফাঁকা রাস্তায় জোর করেই গাড়ির মধ্যে টেনে নেয়। গাড়িতে তুলেই শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। টাকা, মানিব্যাগ, মুঠোফোন, ব্যাংকের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সবই তাদের চাই। মোটরসাইকেল আরোহীদেরও রেহাই নেই তাদের কবলে পড়লে। মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি সবই লুটে নেয় প্রতারক চক্র। রাজধানীতে সক্রিয় হয়ে ওঠা এমন চক্রকে ‘গাড়ি পার্টি’ বলে অভিহিত করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাড়িতে তুলে ছিনতাই করা এমন অন্তত ১০টি চক্র বিমানবন্দর সড়ক, ধানমণ্ডি, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী, বিশ্বরোড, কাওলা, বনানী, মহাখালী, গুলশান, সায়েদাবাদ, গাবতলী, কমলাপুর ও মতিঝিলসহ অভিজাত এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এলাকাভিত্তিক অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ঘটনায় প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা প্রশাসনের দারস্থ হন না। কখনো কখনো থানায় অভিযোগ করলেও প্রতিকার মিলে না।

রাজধানীর বাংলামটর এলাকায় গত ২৩ আগস্ট এমনই একটি চক্রের কবলে পড়েন কাঠালবাগানের বাসিন্দা রিপন মিয়া। তিনি জানান, রাত ৮টার দিকে তিন যাত্রী নিয়ে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে একজন মতিঝিল যাবে বলে ডাকছিল। রিপন চালকের সঙ্গে ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলেন। মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় রাজি হয় চালক। গাড়িতে ওঠার পরই তিন যাত্রী জিম্মি করে তাকে। একজন পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলে, ‘কথা বললেই গুলি করা হবে।’ মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিয়ে পল্টন এলাকায় রিপনকে নামিয়ে দিতে চায় তারা। বিপত্তি বাধায় মানিব্যাগে থাকা একটি ক্রেডিট কার্ড।

যানজটের মধ্যে গাড়ি ধীরে চলতে থাকে, আর ভেতরে চলে জিজ্ঞাসাবাদ! রিপনের কার্ডের পিন নম্বর চায় তারা। রিপন ভুলে গেছে বলে দাবি করলে পিস্তলের বাট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করে একজন। এক পর্যায়ে পিন নম্বর বলে দেয় রিপন। মতিঝিলে ইস্টার্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের কাছে গিয়ে মাইক্রোটি দাঁড়ায়। একজন নেমে যায়। গাড়ি আবার চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটি কল আসে একজনের ফোনে। তখন গাড়ি ঘুরে আবার দৈনিক বাংলামোড়ে আসে। হঠাৎ করেই গাড়ির দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় রিপনকে।

ভুক্তভোগী রিপন জানান, নগদ চার হাজার ও ক্রেডিট কার্ডের ২৩ হাজার টাকা খোয়ান তিনি। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছেন। তবে এর কোনো তদন্ত হয়েছে কিনা জানা নেই তার।

গত ৯ জানুয়ারি ধানমণ্ডির মেট্টো শপিং মলের কাছে এমন একটি দুর্ধর্ষ গাড়ি পার্টির কবলে পড়েন ইব্রাহিম ইউনুস। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। সিরাজগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়ার ছেলে তিনি।

ঘটনার ব্যাপারে ইব্রাহিম ইউনুস জানান, রাত পৌণে ১১টার দিকে একটি কালো রঙের প্রাইভেটকার নিয়ে চারজন তার কাছে আসে। ইউনুসের হলুদ রঙের এফজেডএফ মোটরসাইকেলটির চাবি চায় তারা। চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে জোর করে গাড়িতে তোলে। পরে তারা রাতভর তাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এর মধ্যে গলায় ছুরি ধরে মারধর করে ইব্রাহিমের কাছ থেকে টাকা আদায়ের নানা চেষ্টা করে চক্রটি। তারা নিজেদের প্রশাসনের লোক বলেও পরিচয় দেয়। চক্রটি একে একে ইব্রাহিমের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, টাকা ও আংটি কেড়ে নেয়। রাতের শেষভাগে রফা হয় ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে পরে মোটরসাইকেলটি ফিরে পাবেন ইব্রাহিম ইউনুস। পরে তাকে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে মোটরসাইকেলটি নিয়ে যায় চক্রটি। এ ঘটনার পর তারা ইউনুসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। মোটরসাইলে ফেরত না পেয়ে ১১ জানুয়ারি ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন ইউনুস। পুলিশ ও অনেক ভুক্তভোগী তাকে জানিয়েছে, একটি চিহ্নিত চক্রের কবলে পড়েছিলেন তিনি। এরপরও তার মোটরসাইকেলের হদিস মেলেনি।

ধানমণ্ডি থানা সূত্র জানায়, মামলার আগেই এ চক্রটির ব্যবহৃত সেই কালো গাড়িটি আটক করেছে পুলিশ। গত বছরের থার্টি ফাস্ট নাইটে গাড়িটি চুরি করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলাও রয়েছে। পুলিশ জানায়, মামলার পর এ চক্রের দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘তসি, আদর, মানিক ও আসলাম নামের চারজনএ ঘটনা ঘটায়। তারা ইয়বাসেবী। স্বচ্ছল পরিবারের বখাটে ছেলে। টাকার অভাব হলেই তারা অপকর্মে লিপ্ত হয়। এ চক্রের বিরুদ্ধে থানায় বেশ কয়েকটি অভিযোগ আছে। আমরা তসি ও আদরকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা আবার জামিনে বের হয়েছে।’

রহমত আলী নামের ধানমণ্ডি ৮/এ রোডের এক বাসিন্দা বলেন, ‘ধানমণ্ডিতে গাড়ি নিয়ে লোকজন তুলে ছিনতাই করা অনেক দিন ধরেই চলছে। আট মাস আগে আমার মানিব্যাগ নিয়েছে। আমি থানায়ও যাইনি।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ধানমণ্ডিতে গাড়ি পার্টি শনাক্ত হয়েছে তিনটি। এর মধ্যে কলাবাগান থানা পুলিশ গত বছর একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে। এবার শনাক্ত হওয়া চারজনের এ সিন্ডিকেট অনেক অপকর্ম চালিয়েছে। এ চক্রের সদস্য মানিক কাটাসুর এলাকায় ছিনতাইয়ে সম্পৃক্ত। আদার, আলমাস ও তসি মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের অনেক ঘটনাই ঘটিয়েছে। তাদের সঙ্গে মিরপুর রোডের আশপাশের থানার কয়েকজন পুলিশ অফিসারের যোগাযোগ আছে বলেও জানায় সূত্র। তাই চোরাই গাড়ি ও মোবাইল ফোন নিয়ে প্রকাশ্যে টাকা আদায় করলেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

সম্প্রতি রিপা নামে এক গৃহবধূ টানা পার্টির কবলে পড়ে নিহত হওয়ার পর আরেকটি চক্রকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। এ চক্রটিও মাইক্রোবাস নিয়ে ঘুরে ছিনতাই করে। সুযোগ বুঝে যাত্রীদের গাড়িতে তুলে প্রতারণাও করে তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাড়ি পার্টির তৎপরতা সবচেয়ে বেশি বিমানবন্দর রোডে। গত এক বছরে এখানে শিকার হয়ে র‌্যাব-১ কার্যালায় ও সংশ্লিষ্ট থানাগুলোয় অভিযোগ করেছেন শতাধিক ব্যক্তি। এমনই একজন বহুজাতিক কোম্পানি এসিআই-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিল্লোল মাশরেকী। গত বছরের ১৮ জুন অফিসের কাজ শেষে তিনি শেওড়া বাজার এলাকা থেকে মিরপুরের বাসায় ফিরছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছাই রঙের একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় হিল্লোলের পাশে। গাড়ি থেকে চালক ডেকে বলেন, ‘কই যাইবেন?’ হিল্লোল মিরপুর জানাতেই চালক বলে, ‘উঠেন’।

গাড়িতে উঠেই ফেঁসে যান হিল্লোল। গাড়ির ভেতরে ছয়জন মিলে পিস্তল আর ছুরি ঠেকিয়ে জিম্মি করে তাকে। ছিনিয়ে নেয় মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন। মানিব্যাগ থেকে হিল্লোলের তিনটি এটিএম কার্ড বের করে দুর্বৃত্তরা। এরপর দু’জন কার্ডগুলো নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। বাকি দুইজন হিল্লোলকে গাড়িতে নিয়ে বিমানবন্দর সড়কে ঘুরতে থাকে।

একপর্যায় ‘কাম হইয়া গেছে’ বলে হিল্লোলকে বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় নামিয়ে দেয় চক্রটি। তখন রাত পৌনে ১টা। সড়ক বাতির আলোতে হিল্লোল গাড়ির নম্বরটিও (ঢাকা মেট্রো চ- ১৩-৮৬৩৯) স্পষ্টই দেখেছেন। ঘটনার পরদিন তিনি ব্যাংকে যোগাযোগ করে জানতে পারেন. টঙ্গী এলাকার এটিএম বুথ থেকে তাঁর তিনটি কার্ড একাউন্টের ৬৮ হাজার টাকা তুলে নিয়ে গেছে দুর্বত্তরা। এ ঘটনায় গত বছরের ১৯ জুন ক্যান্টনমেন্ট থানায় সাধারণ ডায়রি করেন হিল্লোল। ২১ জুন উত্তরায় র‌্যাব ১ কার্যালয়ে অভিযোগও করেন তিনি। তবে মেলেনি কোনো প্রতিকার।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গত বছরের ১৩ মে কাওলা এলাকায় এমন একটি চক্রের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় হোটেল রেডিসনের কর্মী আলেয়া ফেরদৌসী জলি। পরদিন জয়দেবপুর থানা পুলিশ জলির লাশ উদ্ধার করে। ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব-১ গাড়ি পার্টির সদস্য রাজু ও রাজুর স্ত্রী কবিতাকে গ্রেপ্তার করে। গত বছরের ২২ মে ভোরে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে র‌্যাবের সঙ্গে ‘গুলি বিনিময়ের’ ঘটনায় নিহত হয় গাড়ি পার্টির সদস্য সাজু ও জহির। তবে একই চক্রে আরও ছয় সদস্য আছে; যারা এখনো সক্রিয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, এ চক্রটি ১০ নারীকে ধর্ষণ এবং জলিসহ দুই জনকে হত্যা করেছে। জলির কাছে থেকে চক্রটি নিয়েছিল এক হাজার ডলার, ২৩ হাজার ২০০ ভারতীয় রুপি, এক হাজার টাকা ও ক্রেডিট কার্ড। টঙ্গী ও বনানীর ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেয় তারা। এর আগে জহির, রাজু ও সাজু জলিকে ধর্ষণ করে। গত বছরের ১৪ মে ক্যান্টনমেন্ট গেটের কাছে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত আরেক নারীকে একই কায়দায় গাড়িতে তুলে টাকা, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় চক্রটি। গাজীপুর এলাকায় নিয়ে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে।

র‌্যাব ১-এর তৎকালীন (বর্তমানে র‌্যাব ১৩) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমত হায়াৎ বলেন, ‘একটি পার্টি ধরা পড়ার পর বিমানবন্দর রোড ছাড়াও ধানমণ্ডি এবং মতিঝিলে দুইটি গ্রুপ সক্রিয় থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা মাঝে-মধ্যে অভিযোগ পেয়েছি।’

এদিকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, গত বছরের ১০ জুন বাসাবো রেলওয়ে ওয়ার্কসপ এলাকা থেকে ছিনতাইকারী দলের সদস্য কামলা রাসেল ও মিলু রাসেল নামে দুজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। চক্রটি গাড়িতে যাত্রী তুলে ছিনতাই করে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গত বছরের ৮ জুন রমনা এলাকায় ডিবির সঙ্গে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় নিহত জাকির হোসেন রাজু প্রাইভেটকার নিয়ে ছিনতাই করে এমন একটি দলের প্রধান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২৪টি হত্যাসহ শতাধিক মামলা আছে। এমন আরেকটি গ্রুপের প্রধান পলাতক ‘পুলিশ শাহিন’।

ডিবির উপ-কমিশনার (ডিসি) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, গাড়িতে তুলে নিয়ে বা গাড়ি দিয়ে ছিনতাই করে এমন বেশ কিছু চক্রকে আমরা শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করেছি। ভ্রাম্যমাণ ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের টিম কাজ করছে।



মন্তব্য চালু নেই