শ্রীপুর থেকে নরওয়ে

বাংলার মালালা স্বর্ণা

সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। তাকে বলা যায় বাংলাদেশের মালামা। মালামার মতোই যার স্বপ্নের দিগন্ত সুদূর বিস্তৃত। অবহেলিত নারী বা শিশুর জন্য যার মন কাঁদে সবসময়।

স্বর্ণা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদিঘী গ্রামের দরিদ্র তোতা মিয়ার মেয়ে। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে চরম দরিদ্রতাকেও হার মানিয়েছেন স্বর্ণা। তিনি এখন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। স্বর্ণার স্বপ্ন, গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের অবহেলিত শিশু ও নারীদের পাশে দাঁড়ানোর।

সাহিদা আক্তার স্বর্ণা বর্তমানে প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। গত ৭ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও স্বর্ণা অংশ নেন। ওই সম্মেলনে ১৩টি দেশের ৩২ জন শিশু ও নারী প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলন।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ। সম্মেলনে স্বর্ণা তার জীবনের দুঃখগাঁথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তার মতোই নিপীড়িত শিশুদেরও সচেতন করে সংগ্রামী করার গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ তাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন।

গ্রামের যেখানেই বাল্যবিয়ের কথা শোনতেন সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন স্বর্ণা। কখনো মেয়ে শিশুর মা-বাবাকে বুঝিয়ে আবার কখনো-বা শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভেঙে দিতেন বাল্যবিয়ে। ৮ থেকে ১০ গ্রামের শিশুদের মধ্যে স্বর্ণ এখন এক সম্ভাবনার প্রতীক। Shorna-gives-her-speech-in-annu002o বাংলার মালালা স্বর্ণা

শুক্রবার সকালে সাহিদা আক্তার স্বর্ণার বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল পাশের গ্রামে শিশুদের নিয়ে স্বর্ণা সচেতনতামূলক ‘উঠোন বৈঠক’ করছেন। শিশুদের ওই বৈঠকে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

স্বর্ণা জানান, তার বাবা তোতা মিয়া স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। মা শরিফুন নেছা পড়ালেখা করেননি। তার বাবা সব সময়ে একটি ছেলে সন্তান কামনা করেছেন। মেয়ে সন্তান ছিল অনাকাঙ্খিত। ছেলে সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার মাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতেন বাবা। বোনদের সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করতেন। পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাদের শিশু বয়সেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তোতা। জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ায় ইসমত আরা কয়েকদিন পরই স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেন তার বাবা।

গত ২০০৫ সালে যখন তার মাকে তালাক দেন তার বাবা তখন তিনি মাওনা ইউনিয়নের বারোতোপা আফসার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী।

স্বর্ণা আরও জানায়, নবম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে পাশের চকপাড়া গ্রামের এক নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে তাকে না জানিয়ে তার বিয়ের দিন-ক্ষণ ঠিক করে তার বাবা। বিয়ের কথা জানতে পেরে প্রথমে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তাতে কাজ না হলে সিংদিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি রেজাউল করিম রুজবেল, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ গ্রামের শিক্ষকদের ঘটনা জানান। তার বাবা সিদ্ধান্ত না বদলালে তিনি তার নানা বাড়ি গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। এতে তার বাল্যবিয়ে ভেঙে যায়। এরপর তার পড়ালেখার খরচ দিতে না চাইলে তিনি প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পড়িয়ে তার পড়ালেখার খরচ জোগাতে থাকেন।

২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাশ করেন স্বর্ণা। এরপর আবারও তাকে বিয়ে দিতে ওঠেপড়ে লাগেন তার বাবা। পোশাক কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার বিয়ের দিন-ক্ষণও ঠিক করা হয়। এবার তার বাবার সঙ্গে যোগ দেয় তার বড় ভগ্নিপতি। তিনি রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে মারধরও করেন। কিন্তু তার অমতে বিয়ে দিলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন। এতে পিছু হটে তার বাবা ও ভগ্নিপতি।Shorna-with-Norway-Prime-Minister বাংলার মালালা স্বর্ণা

দুইদফা তিনি নিজের বিয়ে পণ্ড করায় গ্রামে নানা কথা রটে। কেউ বলেন, মেয়ের অন্য কারো সঙ্গে গভীর প্রেম রয়েছে। কেউ-বা বলেন এ কেমন জাতের মেয়েরে বাবা!

এরই মধ্যে প্রতিবেশী এক শিশুর বাল্যবিয়ের খবর জেনে ছুটে গিয়ে অভিভাবকদের বিয়ে বন্ধ করার অহ্বান জানান। তিনি ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলা নারী বিষয়ক কর্মকর্তাকে ঘটনা জানান। পরে উপজেলা নারী বিষয়ক কর্মকর্তা বিলকিস নাহার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিয়ে ভেঙে দেন।

স্বর্ণা জানায়, এভাবে গ্রামে একের পর এক বাল্যবিয়ে পণ্ড করে দেন তিনি। কিন্তু গ্রামে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিংদিঘী গ্রামে শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলে ‘সূর্যমুখী শিশু ক্লাব’। পাশাপাশি তিনি অন্তর্ভুক্ত হয় প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে গত ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।

স্বর্ণা জানায়, শিশুদের ছয়টি মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে তিনি তার সংগঠনের শিশুদের নিয়ে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের ঘরে-ঘরে গিয়েছে। বাড়িয়েছে সচেতনতা।

স্বর্ণা দৃঢ় আশা প্রকাশ করে জানান, তিনি শুধু তার ইউনিয়নেই নয়, সারা দেশে ঘরে-ঘরে শিশুদের সচেতShor004y বাংলার মালালা স্বর্ণানতা বাড়াতে কাজ করতে চান। বাল্যবিয়েসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সারাদেশে বিপ্লব ঘটাতে চান তিনি।

প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের মিডিয়া অফিসার বিপ্লবী রায় জানায়, দিনভর উপোস দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়াসহ নিজের পড়ালেখার খরচ জোগানোর সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছে স্বর্ণা। দারিদ্রতা আর ঘরের নিপীড়ন তাকে সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছে বলেও সম্মেলনে জানায় তিনি। স্বর্ণার দুঃখগাঁথা শুনে সম্মেলনে যোগ দেয়া সব শিশু ও নারী আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে। সম্মেলনে সাহিদা আক্তার স্বর্ণাকে বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ বলেন,‘স্বর্ণা হল বাংলার মালালা ইউসুফজাই।’

নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত স্বর্ণার সফরসঙ্গী ছিলেন, প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের সমন্বয়কারী নার্গিস বেগম।

নার্গিস বেগম জানান, ‘Because I am a girl I Oslo Freedom forum Conferenc’ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা বক্তব্য দেন। গত ২৪ অক্টোবর নরওয়ে থেকে তারা দেশে ফেরেন।

দারিদ্র, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবে অনেক অভিভাবক শিশুদের পীড়নের কারণ। ওইসব ঘরে নিগৃহীত শিশুদের সচেতন হতে হবে। প্রত্যেক শিশুকেই মনে রাখতে হবে, আমার ভেতর রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

স্বর্ণার মা শরিফুন নেছা জানান, কয়েক বছর আগেও স্বর্ণাকে নিয়ে আশঙ্কা ছিShorna-is-giving-her-speech-on-child-marriage-005 বাংলার মালালা স্বর্ণাল। তার ভাষায়, ‘ভাইবব্যা ভাইবব্যা আমার ডর করতো। ভাইবতাম আমার মাইয়াডা অত সাহসী অইলো ক্যামনে! অহন আমিও তার লগে সাহইস্যা (সাহসী) অইয়া গেছি। আমার মতনই আরো ৮ থেকে ১০ গ্রামের শিশু পোলাপাইন আর বেটিরাও সাহইস্যা অইয়া গেছে। আমরা সবাই আমগর অধিকার জানি। প্রতিবাদ করতারি।’মাওনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক জানান, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী ক্যাটাগরিতে ২০১৩ সালে সাহিদা আক্তার স্বর্ণা শ্রীপুর উপজেলার সেরা নারী নির্বাচিত হন।

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘স্বর্ণা একদিন আমাদের সমাজ বদলে দেবে। তিনি অসংখ্য শিশুর অপার সম্ভাবনার প্রতীক।’



মন্তব্য চালু নেই