রাজধানীর বুকে এখন বহতা নদী!
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি…।’ রবি ঠাকুরের কবিতার ছোট নদীর মতো গরু পার হোক আর নাই রাজধানীর বুকের নদীতে কিন্তু গাড়ি পার হচ্ছে ঠিকই। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার সড়কগুলো ছোট নদীতেই পরিণত হয়েছে।
তবে রাজপথের এ পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচলের মহা দুর্ভোগের দৃশ্য এখন নগরবাসীর কাছে এখন পরিচিতই। একটু বৃষ্টি হলেই রাজপথ থেকে গলিপথ পানিতে থৈ থৈ করে। এতে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তবে সরকারি ছুটির দিন থাকায় যানজট না থাকলেও সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ঢাকা স্থায়ী বাসিন্দারা শেষ সময়ের ঈদ প্রস্তুতি নিতে ছুটছেন শপিংমলগুলোর দিকে। কিন্তু রাস্তা ঘাটের এ অবস্থাতে দুর্ভোগের সীমা নেই।
ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেবাগানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগরীর সড়কগুলো খোঁড়াখুড়ি শেষ করার কথা থাকলেও বুধবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকাঘুরে দেখা গেছে, এখনো খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। কোথাও কোথাও খোঁড়া গর্ত পরিণত হয়েছে ছোটখাট নর্দমায়। উপচে পড়া পানিতে রাস্তা সমান নাকি গর্ত খোঁড়া, তা বোঝার উপায় নেই। এ অবস্থায় রাস্তা চলাচলে ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব গর্তে পড়ে আহত হচ্ছেন অনেকেই।
সরে জমিন দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে নগরীর সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ির সরকারি অনুমতি না থাকলেও তা মানছেন না কেউই। ফলে একটু বৃষ্টিতেই কাঁদা-পানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে খানাখন্দ। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অনেক রাস্তাতেই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। বিভিন্ন সেবাসংস্থা মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রতিবছর একই সড়ক একাধিকবার খোঁড়া হচ্ছে। এতে বাড়ছে নাগরিক দুর্ভোগ, অপচয় হচ্ছে সরকারি অর্থ।
নগরবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন সংস্কার না করা এবং কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে নেই কাজের সমন্বয়। এ কারণেই যতো দুর্ভোগ নগরবাসীর।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২ অফিসের সামেন খিলগাঁও তিলপাপাড়া সড়কটিতে অতীতে কখনো পানি জমেনি। কিন্তু বুধবারের টানা বৃষ্টিতে সড়কটি পরিণত হয়েছে ভরা জোয়ার সম্পন্ন একটি ছোট নদীতে। সড়কটির এমন পরিবেশ দেখে পাশের দোকানদার রাজা চিৎকার করে বলেন, ‘আমাদের নদীতে জোয়ার এসেছে।’ পরে তিনি বলেন, ‘এই রাস্তাটির যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে অন্য রাস্তাগুলো তো নদীতে পরিণত হবে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সিটি করপারেশন ও ওয়াসার কোনো লোককেই এ এলাকায় আমরা দেখি না। দীর্ঘদিন ধরেই ড্রেনগুলোর কোনো সংস্কার নেই। তাই পানি সরতে পারে না। অল্প বৃষ্টি হলেই পানি জমে যামে দোকান পর্যন্ত চলে আসে।’
একই অবস্থা রাজধানীর ফরিকরাপুল, আরামবাগ, রাজারবাগ, যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, আগারগাঁও, মিরপুর, গুলশানসহ পুরো নগরী। এসব এলাকায় ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা কাযকর নেই। ফলে বৃষ্টির পানি জমে থাকলেও সরে যাওয়ার কোন পথ থাকে না। তাই দিনের পর দিন হাটু পানিতেই চলাচল করতে হয় ওই এলাকার মানুষকে।
পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুড়ির জন্যও খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে।
এ দিকে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে ওয়াসার ড্রেন ও নগরীর খালগুলো দখলকেই দায়ী করছেন নগরপরিকল্পনাবিদরা। এ বিষয়ে বিআইডাব্লিউটিএ’র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী, পবার নির্বাহী সদস্য ও নগর বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকার প্রায় ৬৭টি খালের মধ্যে আমরা ২৬ খালই বেদখল। বাকি খালগুলোর অবস্থা ব্যহাল। এগুলো উদ্ধারে উল্লেখ যোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। ওয়াসার কর্মকর্তাদের যোগসাজসেই প্রভাবশালীরা খালগুলো দখলে মরিয়া।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একাধারে বৃষ্টি হয়। এতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই নগরীর বিভিন্ন স্থানে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া যে স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় সেখানে পাম্প স্থাপনের মাধ্যমেও জলাবদ্ধতা দূর করা যায়।’
মন্তব্য চালু নেই