যোগগুরু থেকে ব্যবসাগুরু

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, বিখ্যাত হিথ্রো বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছিল ভারতের নামকরা যোগগুরু বাবা রামদেবকে। ঠিক কেন রামদেবকে আটক করা হয়েছিল তা প্রাথমিকভাবে ভারতের দূতাবাস কর্তৃপক্ষ চাউর করতে চাননি। কিন্তু ধর্মের কলতো বাতাসে নড়ে, আর স্বয়ং যোগগুরু রামদেব যেখানে ধর্মেরই মানুষ তাই সত্য বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারেনি। মার্কিন দূতাবাস থেকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ব্যবসায়িক ভিসা সংক্রান্ত কিছু জটিলতার কারণে তাকে আটক করা হয়েছিল। তখন ভারতের বিকল্প ধারার অনেক বিশ্লেষকই ‘রামদেবের ব্যবসায়িক ভিসা’ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু তখন অবশ্য বিষয়টি যেভাবেই হোক এড়িয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু মাস কয়েক ঘুরতেই বোঝা যায় বাবা রামদেবের ব্যবসায়িক ভিসার আসল রহস্য। ভারতীয় মিডিয়ার কল্যাণে জানা যায় যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ম্যাগি নুডুলসে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে গোটা দেশে ম্যাগি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ওই ঘটনা মাসখানেক পরেই দেখা যায়, যোগগুরু বাবা রামদেব নিজে তার আশ্রমে সকল ভক্তদের সামনে বসে ওই নুডুলস খাচ্ছেন এবং সবাইকে জানাচ্ছেন যে, তিনি যেহেতু খেতে পারছেন তাই সকলেই খেতে পারবেন। এরপরই মূলত একের পর এক বাবা রামদেবকে বিভিন্ন বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কথিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দেখা যায়। বর্তমানে একেবারে নিতান্ত শ্যাম্পু থেকে শুরু করে খাবার স্যালাইন পর্যন্ত তার নামে বিক্রি হচ্ছে, বাদ যাচ্ছে না কাপড় ধোয়ার সাবান পর্যন্ত।
অন্য কোম্পানির হয়ে বিজ্ঞাপন করার পাশাপাশি গত বছর রামদেব তার ‘পতঞ্জলি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানটির অনেক প্রসারও করে ফেলেন। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গত বছর তার প্রতিষ্ঠান তিনশ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। রামদেবের হিসেব যদি সত্যি হয়, তাহলে ভারতের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পতঞ্জলি অগ্রগন্য হবে। যদিও কংগ্রেস সরকার থেকে বর্তমান বিজেপি সরকার কেউই পতঞ্জলির অর্থনৈতিক উৎস এবং বিস্তার সম্পর্কিত কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ঠিকই তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেলেছে।
ঠিকঠাক যোগগুরুর পোশাক পরিহিত রামদেবকে দেখতে প্রথাগত সন্ন্যাসী বলেই মনে হয়। কিন্তু ভারতের উত্তরাঞ্চলের হরিদ্বারে অবস্থিত তার কারখানায় গেলে রামদেবের সন্ন্যাসী মুর্তির চেয়ে ব্যবসায়িক মুর্তিটিই বেশি দেখা যায়। ব্যবসায়ে আধুনিক যত পদ্ধতি বা বাজারজাতকরণ পন্থা তার সবই রামদেবের আয়ত্বে। আর তাকে সর্বদা ঘিরে থাকে একদল সশস্ত্র দেহরক্ষী, যাদের পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে রামদেবের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হয়েছে। তিনি যখন কারখানায় প্রবেশ করেন তখন কর্মচারীদের মধ্যে তার পা ধরে আর্শীবাদ নেবার হিড়িক দেখা যায়।
গত দশ বছর ধরে রামদেব ও তার শিষ্য আচার্য্য বালকৃষ্ণ এই ব্যবসা দেখাশুনা করছেন। রামদেবের ভাষ্যে, ‘ভারতে খাবার, কসমেটিকস এবং ঔষধ মূলত বিদেশ থেকে আনা হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের দেশের অর্থ বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। তারা কম অর্থ লগ্নি করে কিন্তু নিজেদের দেশে অনেক মুনাফা নিয়ে যায়। আমরা চাই ভারতের অর্থ ভারতেই থাকুক।’
রামদেব তার কারখানার কোনো পণ্যে মেইড ইন ইন্ডিয়া শব্দটি লেখার পরিবর্তে শুদ্ধ হিন্দিতে লেখেন ‘মেইড ইন ভারত’। তিনি মনে করেন, এই শব্দটির কারণেই তার পণ্য মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়েছে। ভারতে প্রাপ্ত সকল কাচামাল দিয়েই মূলত তার কারখানার পণ্য তৈরি হয়। একেবারে খাবারের ঘি থেকে শুরু করে কসমেটিকস পর্যন্ত এই কারখানায় তৈরি হচ্ছে। এমনকি টাক মাথায় চুল ওঠে এমন তেলও বিক্রি করছে তার প্রতিষ্ঠান পতঞ্জলি।
নাজির আহমেদ তেমনই এক খদ্দের যিনি গত এক বছর ধরে বাবা রামদেবের কারখানার পণ্য ব্যবহার করে আসছেন। তার কথা হলো, রামদেব একজন স্বচ্ছ ও ভালো মানুষ। তাই তার উপর বিশ্বাস করে তার পণ্য ব্যবহার করে যাচ্ছেন তিনি এবং তার পণ্যগুলো পবিত্রও বটে। শুধু নাজির আহমেদই নন, এমন অনেককেই পাওয়া যাবে যারা স্রেফ রামদেবের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পণ্য ব্যবহার করছেন। অবশ্য পণ্যের এই বিশাল ব্যবসার বাইরেও রামদেবের অপর একটি লাভজনক ব্যবসা হলো তার লেখা বই ও যোগ শেখানোর সিডি। প্রতিদিন গোটা ভারতবর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ রামদেবের যোগ শেখানোর বই ও সিডি বিক্রি হয়।
মন্তব্য চালু নেই