যে কারণে সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে

অবশেষে সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ওপেক এর সদস্য দেশগুলোর বহুল প্রতিক্ষীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুরো বিশ্ব গত কয়েকমাস ধরে যা জানার অপেক্ষায় ছিল এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অবশেষে তা উদঘাটিত হয়েছে।

ওপেকের নভেম্বর সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, সৌদি আরব তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের খেলায় মেতে উঠেছে। দেশটি ওপেক সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে দৈনিক সর্বনিম্ন ৩ কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদনে বাধ্য করছে। এর উদ্দেশ্য বাজারে তেলের দাম কমিয়ে রাখা।

পরিণতিতে শুধু ২০১৪ সালেই তেলের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে। ফলে ২০১০ সালের মে মাসের পর থেকে এই প্রথমবারের মতো প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য ৭০ মর্কিন ডলারের নিচে নেমে আসে।

কিন্তু প্রশ্ন হল- কেন সৌদি আরব ওপেক এর সদস্য দেশগুলোর সুনাম ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি সংগঠনটিকেও দূর্বল করার ঝুঁকি নিচ্ছে? এবং ভবিষ্যতে ওপেককে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যবহারের সম্ভাবনা নষ্ট করছে?

সৌদি আরব আসলে এক ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া খেলায় মেতে উঠেছে। এতে শেষবিচারে সৌদি আরবেরই দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে আপাতত দেশটির কোনও মাথা ব্যাথা নেই।

১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ শেষে বিশ্বের প্রথম তেল সংকটের পর সৌদি আরব প্রথমবার বুঝতে পারে যে, বিশ্ব বাজারে তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে তারা কী খেলাটা খেলতে পারবে।

কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল যে, সৌদি আরব বিশ্ব বাজারে অতিরিক্ত তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে তেলের বাজারদরের ভারসাম্য বজায় রাখবে। কিন্তু তা না করে সৌদি আরব বরং পুরোপুরি উল্টো কাজটিই করল।

কারণ রিয়াদ বিশ্বকে নিষ্ঠুর বলেই মনে করছে। এছাড়া সৌদি আরব যেসব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন সে বিষয়গুলোর সমাধানেও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা এবং আঞ্চলিক অংশীদাররাও তেমন কোনও সাঁড়া দিচ্ছে না।

সৌদি-ইরান সম্পর্কের টানাপোড়েন

অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে একটি স্নায়ু যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ইস্যুতে ইরানের যে কোনও অর্জনকে সৌদি আরব নিজের ক্ষতি হিসেবেই দেখছে। এছাড়া আল সৌদ রাজপরিবারের বিপদ ঘন্টাও বেজে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবার কার্যকরভাবেই ফাঁদে আটকা পড়েছে। ফলে মার্কিনিরা ইরানকে ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছে।

আভ্যন্তরীনভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনও অনুমোদন থাকবে না বলেই ধারণা করা হয়েছিল। বিনিময়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তার কথা না হয় বাদই দিলাম।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো অভিনব সব উপায়ে গত কয়েকমাস ধরেই ইরানের উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি বিনিময়ে ছোটখাটো কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তেহরানের কট্টরপন্থীদেরকে শান্ত করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, সৌদি আরব ইরানের উদারবাদি প্রেসিডেন্ট রুহানির উত্থানকে নিজেদের জন্য বিপজ্জনক হিসেবেই বিবেচনা করছে। সৌদি আরবের আশঙ্কা এর মধ্য দিয়ে ইরানে এমন একটি শাসক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটছে যারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে চায়। আর এই শাসকগোষ্ঠী পুরো বিশ্বের কাছেও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে সৌদি আরব যতটা না উদ্বিগ্ন তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি নিয়ে।

ইরাকের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সবই ইরানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনকি ইরানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরসিজি) যদি উত্তর ইরাক এবং কুর্দিদের নিরাপত্তায় সহায়তা করা বন্ধ করে দেয় তাহলে ইরাকের প্রধান শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ছাড়া বাকী সব এলাকাতেই আইএস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, আইএসও সৌদি রাজতন্ত্রের ঘোরতর বিরোধী একটি সংগঠন।

এদিকে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা শুরুর পর থেকে দেশটির বাশার আল আসাদ সরকারের উপর পশ্চিমাদের চাপ তুলে নেওয়া হয়েছে। আগে যেখানে পশ্চিমারা বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল সেখানে এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী আসাদ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে চাইছে। কারণ পশ্চিমারা আইএসকেই প্রধান হুমকি মনে করছে। আর আইএসকে মোকাবেলা করার জন্যই তারা আসাদ সরকারের মতো ‘স্বৈরশাসক’কেও ছাড়া দিতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, আসাদ সরকারের সঙ্গে আবার ইরানের সখ্যতা রয়েছে।

ফলে ইরানের আর্থিক সহায়তা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানের মদদপুষ্ট হিজবুল্লাহর সহায়তা আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার সমর্থন পেয়ে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে আপাতত পুরোপুরি নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, সিরিয়ার আসাদ সরকারও আল সৌদ রাজ পরিবারের ঘোরতর বিরোধী।

ওদিকে সৌদি রাজতন্ত্রের দক্ষিণ সীমান্তে ইয়েমেনের শিয়া বিদ্রোহীদের উত্থান এবং পশ্চিম সীমান্তে বাহরাইনের শিয়াদের বিক্ষোভসহ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হচ্ছে যেন ইরান চারদিক থেকে সৌদি রাজ পরিবারের টুঁটি চেপে ধরছে।

যে কারণে সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে
পাল্টা আঘাত

মাধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা থেকে শুধুমাত্র ইরানেরই সুবিধা হচ্ছে দেখে সৌদি আরবও পাল্টা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সৌদি আরব যেহেতেু সামরিকভাবে ইরানের সঙ্গে কোনও বিবাদে জড়াতে আগ্রহী নয় সূতরাং দেশটি ভিন্ন কোনও উপায় খুঁজতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ উপায়টি হল তেহরানের পেছনের পকেট কাটা।

ইরানের অর্থনীতি প্রধানত হাইড্রো কার্বন নির্ভর। ২০১৩ সালে ইরানের রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ এবং জিডিপির ২৫ শতাংশই এসেছে হাইড্রোকার্বন থেকে।

সিরিয়া এবং ইরাকে লড়াই অব্যাহত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইরান গত এক মাসে দেশ দুটিতে অভিযান চালাতে গিয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যায় করেছে। এর পাশাপাশি ইরান এর সম্ভাব্য আভ্যন্তরীন অস্থিরতা মোকাবেলার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, চমকপ্রদভাবে নভেম্বরের ভিয়েনা সম্মেলনের আগে ইরান ওপেকভুক্ত দেশগুলোর তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনার প্রস্তাব করে। ইরানের উদ্দেশ্য ছিল এর মধ্য দিয়ে তাদের উপর সৌদ আরবের দাবড়ানি প্রতিরোধ করা। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই মূলত সৌদি আরবের তেলকে রাজনৈতকি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের খেলায় মেতে ওঠার বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়।

তেলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সৌদি আরব সিরিয়ার আসাদ সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালি মিত্র রাশিয়াকেও কাবু করার সুযোগ পাবে। কারণ রাশিয়ার অর্থনীতিও হাইড্রোকার্বন থেকে আহরিত রাজস্বের উপর বিশালাংশে নির্ভরশীল। বিশ্ব বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে এর দাম কমিয়ে রাখার ফলে রাশিয়ার আভ্যন্তরীন অর্থনীতির ভিতও নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। কারণ তেলের দাম কমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দামও কমছে। চলতি বছরের জুন থেকেই বিশ্ব বাজারে রুবলের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে।

এক ঢিলে দুই পাখি (সিরিয়া ও ইরান) মারার সৌদি আরবের এই কৌশল আপাতত খুবই আকর্ষণীয় বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত সৌদি আরব যেহেতু কারও সঙ্গে সরাসরি সামরিক বিবাদে লিপ্ত হতে ইচ্ছুক নয় সেহেতু এর চেয়ে ভালো কোনও উপায় নেই।

যে কারণে সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে
সৌদি আরবের রয়েছে বিশাল তেলের রিজার্ভ

কিন্তু প্রশ্ন হল- কতদিন পর্যন্ত সৌদি আরব এই খেলা খেলতে সক্ষম হবে? সত্যি বলতে গেলে সৌদি আরব আরও অন্তত কয়েকমাস এই খেলা খেলতে পারবে। কিন্তু তেলের দাম যদি অব্যাহতভাবে কমতে থাকে তাহলে সৌদি আরব তাদের কৌশল বদলানোর বিষয়টি চিন্তা করবে।

এছাড়া সৌদি রাজতন্ত্রের হাতে ৭৪১ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এর সঙ্গে গত অর্থ বছর শেষে যোগ হয়েছে আরও ১৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত। আর প্রয়োজনে আগামী কয়েক বছরের বাজেট ঘাটতি মেটানোর সক্ষমতাও রয়েছে দেশটির।

অন্যদিকে সম্প্রতি সৌদি আরব বিশাল পরিমাণ অস্ত্র কিনে রেখেছে। যার ফলে আগামী কয়েকবছর প্রতিরক্ষা খাতেও ব্যায়ের পরিমাণও কমে আসবে। এতে নতুন নতুন প্রকল্প শুরুর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থও থাকবে আল সৌদ পরিবারের হাতে।

তবে তেল অস্ত্র ব্যবহার করে ইরান ও সিরিয়াকে কিছুটা জব্দ করা গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হবে সৌদি আরব।

এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আইএস বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়াজুড়ে প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের সমান আয়তনের একটি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি সংগঠনটির নেতা এবং ইসলামের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির ১৭ মিনিটের এক ভিডিও বার্তায় সৌদি রাজ পরিবারের প্রতি আইএস এর ঘৃনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি আইএস আল-সৌদ রাজপরিবারকে ব্যাঙ্গ করে আল-সলুল নামকরন করেছে।

আইএসও সস্তায় তেল বিক্রি করে প্রতিদিন মিলিয়ন ডলার আয় করছে। ফলে সৌদি আরব আইএস এর কয়েকটি ঘাঁটিতে সফলভাবে হানা দিতে সক্ষম হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের প্রকাশ্য সহায়তা ছাড়া আইএসকে পরাস্ত করতে পারবে না। এর ফলে সৌদি আরবকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে হবে।

তেমনি সৌদি আরবকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এ বিষয়টি মেনে নিতে হবে যে, মধ্যপ্রাচ্যে একটি সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধ এড়াতে হলে ইরান এবং পি-ফাইভ প্লাস ওয়ান অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি এই ছয় পরাশক্তির মধ্যে যে কোনও ধরনের একটি সমঝোতা হতে হবে।

আর এই অপশনটিই এখন সৌদি আরবের জন্য মন্দের ভালো হিসেবে সামনে রয়েছে। ইরানের সঙ্গে বোঝাপোড়ার ক্ষেত্রে সৌদি আরব সম্প্রতি কুটনৈতিক উপায়কেই যে প্রধান অবলম্বন করছে তাও ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষকরে আইএস এর মতো সংকট মোকাবেলায় ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের আচরণকে ইতিবাচকই বলতে হবে।

তবে এরপরও পরস্পরের প্রতি গভীর সন্দেহ এবং অবিশ্বাস থাকবেই। আর আইএস এর মতো ভয়ঙ্কর হুমকির উত্থানেও সৌদি রাজতন্ত্র ইরানকে জব্দ করার মনোবাসনা থেকে সরে আসবে বলে মনে হয় না।

লেখক : মাইকেল স্টিফেনস, বিবিসি

অনুবাদ : মাহবুবুল আলম তারেক,



মন্তব্য চালু নেই