যে কারণে মুসলিম রোহিঙ্গা হত্যাকণ্ডে নিশ্চুপ আরব দেশগুলো

সৌদি আরব মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সৌদি আরবের মত অন্যান্য আরব দেশগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।মক্কা ও মদিনায় পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম (কাস্টডিয়ান) হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে সৌদি আরব। পবিত্র মসজিদের খতিব মাঝে মধ্যেই বিশ্বের মুসলমানদের উদ্দেশ্যে খুৎবায় বাণী দিয়ে থাকেন।

অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন বা ওআইসির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৌদি আরবের একজন স্বনামধন্য নাগরিক। কিন্তু কেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে আইএস জঙ্গিদের পেছনে অস্ত্র ও অর্থ দানে নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে অথবা রাজতন্ত্র বহাল রাখার খায়েশে দোর্দ- প্রতাপ থাকা সত্ত্বেও একদিকে বিলাসবহুল জীবন যাপন ও গণতন্ত্রবিহীন স্বচ্ছতা ও জবাদিহীতার অভাবে যে একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা জেঁকে বসেছে তার ফলেই রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের মত ঘটনায় এসব আরব দেশ কোনো উদ্যোগই নিতে পারছে না।

এমনকি মিয়ানমারের সামরিক শাসক ও তল্পিবাহক সুচি সরকারের মত একই অবস্থা বিরাজ করছে আরব দেশগুলোর মধ্যে। ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তি দেশগুলোর কোনো ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরব দেশগুলো বিন্দুমাত্র কোনো উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতা নেই। উপরন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে আরব দেশগুলো বাহরাইন, ইয়েমেনে নিজেদের পছন্দসই সরকার রক্ষার জন্যে জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই প্রভাব সৃষ্টি ছাড়াও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।

এমনি এক সময় মিসরের সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আব্দেল আল সিসি বলেছেন, তার দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের মতপার্থক্যই মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকটের কারণ। সে থাক, কিভাবে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী আরব শেখদের অস্ত্র ও অর্থের বিনিময়ে প্রতিদান দিচ্ছে তা জানলে আপনার শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠবে। ইয়াজিদি নারীদের দাস হিসেবে সৌদি আরবে বিক্রির মাধ্যমে উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়ে দিচ্ছে আইএস জঙ্গিরা।

যাদের এর আগে তারা পাঠিয়েছে অন্যান্য দেশেও। পশ্চিমা মিডিয়ার একাধিক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইয়াজিদি নারী ছাড়াও চুরি করে ইরাকের তেল বিক্রির পাশাপাশি দেশটি থেকে ঐতিহাসিক ও প্রাচীন নিদর্শন বস্তু যেভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে কালোবাজারে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়েছিল তা এখন হচ্ছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে।

বিশ্বের কাছে এটা এখন জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে যে সৌদি আরব ও কাতারসহ বেশ কয়েকটি আরবদেশ আইএস জঙ্গিদের অস্ত্র ও অর্থায়ন করে আসছে। কাতার ইতিমধ্যে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন যদি সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেও নেয় তবুও দেশটি সেখানে বিদ্রোহীদের সহায়তা অব্যাহত রাখবে। দুই বছর আগে ২০১৪ সালে উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার জন পোডেস্টার কাছে পাঠানো একটি ইমেইলের বিষয়বস্তু ফাঁস করে দিয়ে বলেছে, সৌদি আরব ও কাতার সরকার আইএস জঙ্গিদের গোপনে অর্থ ও অন্যান্য কৌশলগত উপকরণ সাহায্য দিচ্ছে। তবে এ দুটি

মুসলিম দেশের কোন কোন শেখ এধরনের সহায়তা দানের সঙ্গে জড়িত তা ওই ইমেইলে বলা হয়নি।এধরনের তহবিল আরব দেশগুলো দেয়ার ফলেই আইএস জঙ্গিরা তা সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ ও ঘৃণ্য অপরাধে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে আসছে। একই সঙ্গে আইএস জঙ্গিরা ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে যে ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে শুরু করে যাদুঘরগুলো ধ্বংস করে আসছে এবং সেখান থেকে ঐতিহাসিক মিনার, প্রাচীন ও পুরাকালের নিদর্শনগুলো লুটপাট করে কালোবাজারে বিক্রি করছে। এসব পণ্যের বড় ক্রেতা হচ্ছে ইউরোপ। তুরস্ক ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকেও আইএস জঙ্গিরা পুরাকীর্তি লুট করে পাচার করছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ পত্রিকা দি গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সুইস কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে সিরিয়ার প্রাচীন নগরী পালমিরা, লিবিয়া, ইয়েমেন থেকে পাচারকৃত পুরাকীর্তির একটি বড় ধরনের চালান জেনেভার মুক্ত বন্দর থেকে উদ্ধার করেছে।

ফরেন পলিসি সাময়িকীতে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রান্সিস তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার লোভি ও অনৈতিক পুরাকীর্তি সংগ্রাহকরা আইএস জঙ্গিদের কাছ থেকে এসব পণ্য কালোবাজারে কিনে নিচ্ছে। তুরস্কের একটি মাফিয়া গোষ্ঠী কিলিস ও উরফা শহরকে দীর্ঘদিন ধরে পালমিরা থেকে চুরিকৃত এসব পুরাকীর্তি পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। এর আগে ইরাক আগ্রাসনে বাগদাদ যাদুঘর থেকে ১৫ হাজার পুরাকীর্তি চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব চুরিকৃত পুরাকীর্তির মাত্র ২৫ ভাগ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে এধরনের পুরাকীর্তি যেভাবে লুঠতরাজ হচ্ছে, বেহাত হয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে আইএস জঙ্গিদের হাত দিয়ে, শুধু দামাস্কাস ও হোম থেকে পাচারকৃত পুরাকীর্তির মূল্য হবে ৩৬ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু আসলে এর মূল্য আরো বেশি কারণ কালোবাজারে চুরির মাল হিসেবেই এগুলো বিক্রি হচ্ছে ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনা করে নয়। আর হলেও সে মূল্য তালিকা অজানা থেকেই যাচ্ছে।

অবাক হওয়ার ব্যাপার যে আইএস জঙ্গিদের সন্ত্রাস শুরু হওয়ার পর তুরস্ক, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ হ্রাস পেলেও পণ্য আনা নেওয়ার পরিমাণ তুরস্কের সঙ্গে এসব দেশের বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা ধারণা করা খুবই সহজ যে কালোবাজারের ডিলাররা ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহারের মাধ্যমেও পুরাকীর্তি পাচার জায়েজ করে নিয়েছে। প্রথমে সিরিয়া থেকে পুরাকীর্তি পাচার শুরু হলেও পরে তা নিরাপদ মনে না করে অন্যান্য পথ ধরা হয় যেখানে পাচারকারীরা আইএস জঙ্গিদের নিয়মিত কর দিয়ে থাকে।

যাইহোক, আরব ও পারস্য উপসাগরের শেখদের কাছে আইএস জঙ্গিরা অর্থ ও অস্ত্র পাওয়ার বিনিময়ে শুধু পুরাকীর্তি ঋণ শোধ হিসেবে পাঠাচ্ছে তা নয়। ইরাকের মসুল শহরের দক্ষিণে একটি ভিডিও উদ্ধারের পর দেখা গেছে সৌদি আরবে ইয়াজিদি নারীদের দাস হিসেবে বিক্রির ব্যবসা জমাজমাট হয়ে উঠেছে। একজন আইএস জঙ্গিকে হত্যার পর তার সেল ফোন থেকে ওই ভিডিও উদ্ধার করা হয়। ২০১৪ সালে মসুলে আইএস জঙ্গিরা হাজার হাজার ইয়াজিদি নারীকে অপহরণ করে। তাদের অনেককে ধর্ষণ করে জঙ্গিরা, বিক্রি করে ফাল্লুজায় এমনকি সিরিয়ায়। কিন্তু পরিস্থিতি সঙ্গীন হয়ে উঠায় এখন সৌদি আরবে অপহৃত ইয়াজিদি নারীদের চালান যাচ্ছে।

ব্রিটিশ পত্রিকা দি সান ইয়াজিদি নারীদের দুর্দশা নিয়ে এধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে আইএস জঙ্গিদের কাছে সৌদি আরবের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের কড়া সমালোচনা করা হয়। যদিও লন্ডন এখনো আইএস জঙ্গিদের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে আছে এবং সিরিয়া ও রাশিয়ার মিলিত আক্রমণে আইএস জঙ্গিরা পিছু হটে নরকে অবস্থান নিচ্ছে।এই যখন অবস্থা তখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে আরব দেশগুলোর নজর দেয়ার সময় কি আদৌ আছে?



মন্তব্য চালু নেই