যে কারণে তারা যৌনপল্লীর পথে
এ প্রসঙ্গে যাবার আগে শিল্পী নচিকেতার সেই গানটির কথা খুব মনে পড়ছে। ‘যে মেয়েটা রোজ রাতে, বদলায় হাতে হাতে, তার অভিশাপ নিয়ে চলাই জীবন। অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন, শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।’
তাই তাদের উদ্দেশে একটি কথা বলাই যায়, যে গল্প অন্ধকারের, সেই অন্ধকার জীবনের শেষ বলে কিছু নেই, যারা জীবন মানে শুধুই অন্ধকার বোঝে। কিন্তু তাদের নিভে যাওয়া আলোহীন জীবনের গল্প তো এমনি এমনি সৃষ্টি হয়না, সেইসব জীবনের পিছনের গল্পগুলোই তুলে ধরা হলো বাংলামেইল পাঠকদের জন্য-
কেসস্টাডি-১: সীতার বাড়ি যাওয়া হয়না। ইচ্ছে যে নাই তা নয়, অনেক বছর হয়ে গিয়েছে বাড়ি যান না সীতা। কিন্তু কড়কড়ে নোট যে প্রতি মাসে পাঠাতে হয় ডায়মন্ড হারবারের কুঁড়ে ঘরে। সেখানেই সীতার জীবনের গল্পের চরিত্রেরা থাকে। ছোট তিন বোন, ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা, অভাগিনী মা। নিজের দেহ বেচা টাকা মাস গেলেই তিনি পাঠিয়ে দেন।, নিজের যাওয়া হয়না। সীতার কথায় যা বোঝা গেল তাতে কেই জোর করে নিয়ে আসেনি এপথে বেঁচে থাকবার তাগিতই তাকে এ পথ চিনিয়েছে। সমাজের কাছে সীতারা নষ্ট মেয়ে।তাই ফেরা হয়না তার।
কেসস্টাডি ২: সে প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা কিংবা তার ও বেশি। শেফালির এখন ৪৫। অন্ধকার জীবনের দীর্ঘ পথ বলা যায়। শেফালি বলেন, ‘বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তাই কলকাতায় কাজ খুঁজতে এসে সোনাগাছিতে চলে আসি। কাজ করতে থাকি। এভাবেই ভাই-বোনদের পড়াশোনা শিখিয়েছি। আমার ছেলে-মেয়েও পড়াশোনা করেছে। ছেলে কাজ করে, মেয়ের ভালো বিয়ে দিয়েছি। নিজের ইচ্ছাতেই আমি যৌনকর্মী, এতে আমার কোনও সঙ্কোচ নেই।’
হয়তো তার আর কোনো অভিযোগ নেই এই সমাজ বা জীবনের প্রতি। নিয়তি নির্ধারিত বলেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সঙ্কোচ তো তাকে দুমুঠো ভাত মুখে তুলে দিবে না। একমুঠো ভাত। কেবল ক্ষুধার জন্য দেহব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, এ রকম উদাহরণ ভুরিভুরি। ৩ থেকে ৫ শতাংশ মেয়েকে জোর করে নামানো হয় এ পেশায়। বাকিরা কম-বেশি নিজেদের ইচ্ছাতেই আসেন।
কিন্তু ফেসবুকে গুজরাটের বদোদরা জেলার এক তরুণীর সরাসরি নিজেকে বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দেখে তারাও অবাক। কোনো জায়গা থেকে সমাজে নিন্দিত হবে জেনেও মেয়েরা বেছে নিয়েছে এই পেশা।
দিল্লিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্টপের প্রেসিডেন্ট রোমা দেবব্রত বলেছেন, ‘আমাদের দেশে এখনও বহু মেয়ে খেতে পায় না। কাউকে অল্প বয়সেই জোয়াল টানতে হয় সংসারের। এ পেশায় টিকে গেলে টাকা বেশি। তাই সেদিকে অনেকেই চলে যাচ্ছে স্বেচ্ছাতেই।’
শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাস সত্যার্থী অভিমত এরকম-দারিদ্র্য আর অভাব, সমাজের এই মূল দুই ব্যাধিকে দূর করতে না পারলে, কোনোভাবেই যৌনপেশায় আসা আটকানো যাবে না। কোন পরিস্থিতিতে পড়লে নিজেকে ভারতের মতো সমাজে কোনো নারী নিজেকে বিক্রি করে দিতে চান?
আর সীতা-শেফালিদের মতো যারা আছেন তারা এখন আর এসব নিয়ে ভাবেন না। সীতার সরল স্বীকারোক্তি, ‘লোকের বাড়ি কাজ করলে কী এত টাকা পেতাম? বাড়ির লোকগুলোকে এতগুলো করে টাকা পাঠাতে পারতাম, বাবা-মায়ের চিকিৎসা হতো?’
এসব কথা বলতে গিয়ে তার এখনও চোখের কোনে অশ্রু চিকচিক করে ওঠে। মনের ভিতরটা হু হু করে ওঠে বাড়ির লোকগুলোর মুখ মনে করে। কিন্তু তাও হাসি মুখে সীতা-শেফালিরা পরিবারকে ভালো রাখতে জীবনকে চালাতে এগিয়ে যান নিশ্চিত অন্ধকারে। ঠিক যে কারণে গুজরাটের চাঁদনি রাজগৌড় নিজেকে পণ্য করে দেন।
মন্তব্য চালু নেই