যে কারণে জোরালো হচ্ছে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ
নির্বাচিত হওয়ার আভাস মিলতেই বিক্ষোভের মুখে পড়েন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই বিক্ষোভ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। সবশেষ খবর অনুযায়ী ওই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১০টি শহরে। বিক্ষোভকালে পুলিশি দমনপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে। এরইমধ্যে শতাধিক বিক্ষোভকারীকে বিক্ষোভস্থল থেকে আটক করারও খবর দিয়েছে সিবিএস নিউজ। কিন্তু কেন এই বিক্ষোভ? কেন তা সহিংস হয়ে উঠছে? ভোটারদের মন্তব্য, সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন আর বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই বিক্ষোভের নেপথ্যে রয়েছে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান। এই শ্লোগানে ভর করেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের পরস্পরের কাছ থেকে বিযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাম্প। বিভক্তির সূত্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষদের বিভাজিত করতে সক্ষম হন তিনি। আর এই বিভাজিত বাস্তবতাই মানুষকে বিক্ষোভে টেনে এনেছে। এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়াতে তাড়িত করেছে তাদের।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগানকে প্রচারণার উপজীব্য করেছিলেন ট্রাম্প। তার এই মহান আমেরিকার ব্যাখ্যায় তিনি সেই কলম্বাসের আবিস্কৃত আমেরিকাকে বুঝিয়ে থাকেন; যা শ্বেতাঙ্গ আাধিপত্যেরই নামান্তর। কালজয়ী ঐতিহাসিক হাওয়ার্ড জিন তার ‘পিপলস হিস্টরি অব আমেরিকা’ নামের গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কিভাবে আদিবাসীদের ওপর হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে এই কথিত আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য কায়েম করা হয়েছিল আর তার নাম দেওয়া হয়েছিল আমেরিকা আবিষ্কার। সেই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের কথিত মহত্ত্বই ছিল ট্রাম্পের নির্বাচনী শ্লোগান। সেই আধিপত্যের বিপরীতে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে স্থাপন করেছেন ট্রাম্প। করতে চেয়েছেন বিভক্ত। মেক্সিকোর সীমান্ত নয় কেবল, মানুষের মনের মধ্যে বিভক্তির দেয়াল তুলতে চেয়েছেন তিনি। সে কারণেই নির্বাচনের ফলাফলের পর হিলারি পরাজিতের ভাষণে তার নেতিবাচক উপলব্ধির কথা জানান। ভাষণে তিনি মন্তব্য করেন, যতোটা ভেবেছি তার চেয়েও অেনক গভীরে বিভক্ত আমেরিকা।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিপরীতে ট্রাম্প দাঁড় করিয়েছিলেন অভিবাসী, মুসলমান, মেক্সিকান, সমকামী ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের। নির্বাচনের আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী, মুসলিম সম্প্রদায়, এলজিবিটি কর্মী, আর কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশ ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘বর্ণবাদী’ ও ‘পুরুষতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, দায়িত্ব গ্রহণের পর নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের রোষানলে পড়তে পারেন তারা।
সেই মানুষেরাই যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তকারী আগামি দিনের প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছেন। এই আমেরিকায় কী করে তারা থাকবেন, সেই সংশয় থেকেই তারা উদ্বেগে পড়েন। হয়ে ওঠেন হতাশ। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেই হতাশাই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে তাদের।
মঙ্গলবার রাতে নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের খবর প্রকাশের পরপরই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিভিন্ন স্থানে ‘নট মাই প্রেসিডেন্ট’, ‘টাইম টু রিভল্ট’, ‘ফ্যাসিস্ট ট্রাম্প’, ‘রেজিস্ট রেসিজম’, ‘নো ট্রাম্প’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভকারীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষজন বিক্ষোভে নেমেছেন, যা সাম্প্রতিক মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন। মঙ্গলবার শুরু হওয়া বিক্ষোভ বুধবার সকালে আরও জোরালো হয়ে উঠে। এমনকি হোয়াইট হাউসের সামনেও বিক্ষোভ করেন ট্রাম্পবিরোধীরা। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে বুধবার সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু হয়। ওয়াশিংটন ডিসিসহ অন্য অঙ্গরাজ্যতেও এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ওয়েস্ট কোস্ট। নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, অস্টিন, সিয়াটল, ওকল্যান্ড, কালিফ, ফিলাডেলফিয়াসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে।পুলিশি বাধার কারণে কোথাও কোথাও সেই বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএস নিউজ বলছে, বিক্ষোভে পুলিশি দমনপীড়নের কারণে তা সহিংস হয়ে ওঠে কোথাও কোথাও। আরেক মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএস নিউজের খবরে বলা হয়, বিক্ষোভে পুলিশি বাধা ও দমনপীড়নের একপর্যায়ে বিভিন্ন শহর থেকে ১৩জন বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুলিশ।
বুধবার দিনের শুরুর দিকে ১৫শ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সান ফ্রান্সিসকো বার্কলে হাইস্কুলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে তা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। সেখানকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র এডাম ব্রেভার বলেন, ‘একজন বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষীকে প্রেসিডেন্ট হতে দিতে পারি না।’ ট্রাম্পের বিজয়কে হতাশাব্যঞ্জক উল্লেখ করেন ড্যানিয়েল কলিন নামের আরেক শিক্ষার্থী। ল্যাতিন শিক্ষার্থী কলিন বলেন,লাতিন আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের কারণে তার আমলে তাদের বন্ধু ও স্বজনদের কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। অকল্যান্ডের ক্যালিফোর্নিয়া কলেজ অব দ্য আর্টসের প্রথম বর্ষের আফ্রিকান-আমেরিকান শিক্ষার্থী ড্যানিয়েল অস্টিন মনে করেন, তার অস্তিত্বের একটা অংশ চুরি হয়ে গেছে- একজন উভকামী কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নয়, বরং একজন আমেরিকান হিসেবে।
লস অ্যাঞ্জেলেসে বুধবার ভোরে লাতিন আমেরিকার শিক্ষার্থী অধ্যুষিত তিন শতাধিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে সিটি হলের সামনে বিক্ষোভ করে। স্প্যানিশ ভাষায় তারা স্লোগান দেন- ‘জনগণের ঐক্য বিভাজিত হবে না।‘ ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সুরের প্রতিধ্বনি করে তারা বলেন, ‘অভিবাসীরাই আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে।’
শিকাগোর ট্রাম্প টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ জানান একদল ট্রাম্পবিরোধী। সেখানে ম্যারিয়ন হিল বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। সেই সঙ্গে আমি, আমার বন্ধুরা এবং আমার পরিবার কিছুটা আতঙ্কিতও। সবকিছুই সামনে আসবে। লোকজনের ঘৃণাটাও বাইরে বেরিয়ে আসবে।’ অপর এক বিক্ষোভকারী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিনি (হিলারি) বেশি ভোট পেয়েও আজ পরাজিত।’
সেই দুঃখবোধ ধ্বনিত হয়েছে পরাজিত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের কণ্ঠেও। বুধবার পরাজিতের ভাষণে (কনসেশন স্পিচ) হিলারি বলেছেন, আমরা যতো ভাবতাম তারচেয়ে বেশি ও গভীরে বিভক্ত আমাদের দেশ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেড়টি বছর লাখ লাখ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পরিশ্রম করেছি। আমরা মনে আমেরিকান স্বপ্ন সবার জন্যই সত্য। নারী, পুরুষ, এলজিবিটি, প্রতিদ্বন্দ্বী সবার জন্য। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমেরিকাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে নিজেদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।’
কোরিয়ান আমেরিকান সেন্টার বলছে, ট্রাম্পের জয়ে তারা ভীত। বিভক্তির রাজনীতি তাদের হতাশ করেছে। তারা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
নির্বাচনের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও একইভাবে ওই বিভক্তিকে সামনে এনেছে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস বলছে, এটি বিভক্ত আমেরিকায় ট্রাম্পের জয়। ব্লুমবার্গ পলিটিক্স এর ভাষ্য, বিভক্ত জাতির প্রেসিডেন্ট হলেন ট্রাম্প। টেলিগ্রাফ বলছে শেষ পর্যন্ত বিভক্ত আমেরিকারই বিজয় হলো! দ্য কনজারভেশন লিখেছে মার্কিন সমাজে বিভক্তির বিষ ছিটিয়ে কুৎসিত জয় পেয়েছেন ট্রাম্প।
ক’দিন আগে সাড়া জাগানো মার্কিন তথ্যচ্চিত্র পরিচালক মাইকেল মুর বলেছিলেন, মুর মনে করেন ট্রাম্পপন্থী ভোটাররা মিশিগান, ওহাইয়ো, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনকে ‘ব্রেক্সিট রাজ্যে’ পরিণত করবেন। মুর বলেন, ‘ব্রেক্সিট একটি বড় অংশে পাশ করেছে তার কারণ হচ্ছে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের শিল্প খাতের কর্মজীবী শ্রেণি ইউরোপ থেকে বের হতে চেয়েছে। কিন্তু জিনিসটা হয়ে যাওয়ার পর তারা উপলব্ধি করেছেন, ‘এখন তো আমাদের ইউরোপ থেকে বের হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার আমরা ইউরোপ থেকে বের হওয়ার জন্য ভোট দিচ্ছি না, কিন্তু ট্রাম্পকে ভোট দিলে আমেরিকাকেই আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়া হবে। ’
থিকস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি সেন্টারের কর্মকর্তা হেনরি অলসেন মনে করেন, ‘মানুষ যখন সমাজের স্বাভাবিকতার সাপেক্ষে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, তখন তারা সমাজে নিজেদের সংযুক্তির প্রশ্নে মরিয়া হয়ে চরমপন্থাকেই নিজেদের অস্ত্র করে তোলে।’ তিনি মনে করেন, সমাজেই চরমপন্থার বাস্তবতা হাজির রয়েছে।’ সেই বাস্তবতার বিপরীতেই আজকের বিক্ষোভে।
কাউন্সিল অব আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনের তরফ থেকে আহমেদ রেজাব জানান, ট্রাম্পের বিজয়ের পর মসজিদগুলোকে কঠোর নিরাপত্তার আওতায় এনেছেন তারা। মুসল্লিদের জীবনের সুরক্ষায় তাদের সাবধানতা আবশ্যক।
সূত্র: রয়টার্স, মার্কেট ওয়াচ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, এনবিসি, আল-জাজিরা।
মন্তব্য চালু নেই