বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)
যেখানে সবাই দালাল!
সর্ষের ভেতর ভূত- এই পুরনো আপ্তবাক্যটি যেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বিআরটিএ’র সমার্থক। সর্ষের মধ্যে ভেজাল থাকলে ভূত তাড়াতে সেই সর্ষে যেমন কাজ হয় না, ঠিক একই অবস্থা বিআরটিএ’র। এখানে দালাল ছাড়া কোনো কাজ প্রায় অসম্ভব। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও স্বীকার করেন তার এই দপ্তরের দুর্নীতির কথা।
কেন থামছে না বিআরটিএ’র দুর্নীতি বা দালালদের দৌরাত্ম? দেশের একটি অন-লাইন নিউজ পোর্টাল-এর পক্ষ থেকে সরেজমিনে এ বিষয়ে চালানো হয় অনুসন্ধান। দেখা যায়, এখানকার কর্মকর্তারাই নিয়োগ দিচ্ছেন দালালদের! যারা তাদের হয়ে ‘কাজ’ করছে মাঠপর্যায়ে।
সকাল ১০টা। বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে যেতেই সামনে এসে দাঁড়ালো এক কিশোর। নাম ইমরান (১৭)। সরাসরি প্রশ্ন- ‘মামা কি করাইবেন? লাইসেন্স না ফিটনেস?’
পরিচয় গোপন রেখে বললাম, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স করাবো’। কথা শেষ না হতেই ইমরান ফোন করে তার ফুপাকে। ফোনে তাদের কথোপোকথন ছিল এ রকম- ‘ফুপা, একটা গ্রাহক পাইছি। জলদি আসেন। পরে কিন্তু মিস হইয়া যাইবো।’ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই সেখানে হাজির হন ফুপা রফিকুল ইসলাম (৩৫)।
এসেই তিনি জানান কিভাবে দ্রুত ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। একপর্যায়ে রফিকুল বলেন, ‘ভাই কাজ করিয়ে নেন। কোনো টাকাই মাইর যাইবো না। নতুন মোটর সাইকেলের লাইসেন্স তো মাত্র ৭ হাজার টাকায় করিয়ে দেবো। প্রথমে কিস্তিতে ৪ হাজার, তারপর পাবেন একটি লার্নার কার্ড। তিন মাস পরে পরীক্ষা দেয়ার পর পাবেন মূল লাইসেন্স। এই পরীক্ষার জন্য কোনো ভাবতে হবে না। আপনাকে প্রশ্নপত্রও সরবরাহ করা হবে।’
কথোপকথনের একপর্যায়ে রফিুকুল জানান, প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫টি কাজ করান তিনি। এজন্য তাকে কোনো বেগ পেতে হয় না। কার্যালয়ের সব কর্মকর্তাই তার পরিচিত এবং কর্মকর্তারাই তাদেরকে কমিশন দেন। রফিকুলেরও আছে ইমরানের মতো কিছু সহযোগী। যারা ‘মক্কেল’ দরে খবর দেয় তাদের কাছে।
রফিকুল নিজেকে কাফরুল থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় দিতেই বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। কেউ তার কাছে কাজের জন্য এলে কথার একপর্যায়ে হাতে ধরিয়ে দেন নিজের ভিজিটিং কার্ড। এটা হচ্ছে বিশ্বস্ততা অর্জনের এক প্রকার গ্যারান্টি পত্র!
রফিকুলের মতো এই কার্যালয়ের আশপাশ ও ভেতরে রয়েছে অর্ধশতাধিক দালাল। এখানে কেউ তাদেরকে দালাল বলে না। তারা ‘গ্যাটিস’ নামে সমাধিক পরিচিত। এখানকার প্রায় সব ‘গ্যাটিস’ কিংবা দালালই নিজেদের পরিচয় দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী, কেউ বা আবার আওয়ামী যুবলীগ কর্মী।
‘বারো হাত কাকুড়ের তের হাত বিচি’র মতো এখানে গ্রাহকের চেয়ে দালালই বেশি। প্রধান গেটের আশপাশ থেকে শুরু করে সবখানেই দালাল আর দালাল। তাদের দৌরাত্ম এতোটাই যে চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো গাড়ির মালিকের পক্ষে এক পাঁ বাড়ানো সম্ভব না। দালাল ছাড়া যেন কোনো কাজই হয় না।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১১৭ নম্বর রুমের বাইরের সাঁটানো ‘প্রবেশাধিকার নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড। অথচ সেখানে অনায়াসেই প্রবেশ করছেন কিছু ব্যক্তি। এখানে বিপ্লব নামে এক ‘গ্যাটিস’র কাছে ফিটনেসের বিষয়ে গ্রাহক সেজে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা দেন, ফিটনেসের সব কাগজপত্র ভিতর থেকেই ঠিক হয়ে আসবে। কোনো চিন্তা করতে হবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দালাল জানান, তাদের হাতে কোনো কারিসিমা নেই। তারা সবই করান কর্তাদের হাত দিয়ে। তারা শুধু কর্তাদেরই এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। আর বিনিময়ে তারা পান কিছু কমিশন।
তিনি জানান, আগে অনেক কিছুই হাতে করা হতো। তাই অতোটা সহজ ছিল না সব। কিন্তু ডিজিটাল হওয়ায় এখন সবই সহজ হয়ে গেছে। চোখের পলকেই কম্পিউটারের মাধ্যমে গ্রাহকের সামনেই কাগজপত্র করিয়ে দিতে পারেন স্যারেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ভবনে যারা বিভিন্ন সময়ে মাস্টার রোলে চাকরি করেছেন তারাই চাকরির মেয়াদ শেষে হয়ে যান দালাল। কার্যালয়ের ভেতরেই পাওয়া গেল এমনই একজন দালাল, যার নাম লিটন (৩০)। মাস তিনেক আগে বিআরটিএ’র কার্যালয়ে মাস্টার রোলে চাকরি করতেন তিনি। সম্প্রতি দুর্নীতির দায়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাকে চাকরিচ্যুত করেন। এখন দালালি করেই অর্থ উপার্জন করছেন বলে তিনি নিজেই জানালেন। যখন তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার হাতেই ছিল ছয়টি কাগজপত্রের খাম।
জানা গেছে, কার্যালয়ের পিয়ন থেকে শুরু করে সবার সঙ্গেই দালালদের রয়েছে বেশ সখ্যতা। তাই যেকোনো কাজ তারা অনায়াসেই করাতে কোনো ধরনের বেগ পেতে হয় না। তবে কেউ এখানে দালাল ছাড়া নিজে কাজ করতে গেলে তাকে পদে পদে লাঞ্ছনা, বিড়ম্বনা ও হয়রানিতে পড়তে হয়। কাগজপত্রে সামান্য ভুল থাকলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাও যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেন। তবে এখানে দালালদের দৌরাত্মর কথা স্বীকার করতে চান না কর্মকর্তারা।
দালাল প্রসঙ্গ উঠাতেই বিস্মিত বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক আনিসুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘কই দালালতো এখানে নেই! সবাই আমাদের কাছেই এসে কাজ করাচ্ছেন। আপনি কোথায় দালাল পেলেন?’
এদিকে বিআররটিএ’তে শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত আনসার বাহিনীর সদস্যরা যেন কাঠের পুতুল। আর হবেই বা না কেন? তাদের পকেটে এমনইতেই চলে আসে মাসোহারা। রাজু নামের এক দালাল জানান, এসব আনসার সদস্য দালালদের কাছ থেকে মাসোহারা পায়। তাই তাদের কাছে আনসাররা ‘মামা’ নামেই পরিচিত।
বিআরটিএ কার্যালয়ে দালালদের দৌরাত্ম দেখে অতিষ্ঠ উত্তরা থেকে আসা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাফর আহমেদ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারের এতো চেষ্টা সত্বেও কাজের কাজ হচ্ছে না। হবেই বা কেমন করে, যারা কর্মকর্তা তারাই তো ‘উপরি কামাইয়ের’ জন্য বসে থাকেন। নিয়মানুযায়ী একটি নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে লাগে ২ হাজারের একটু বেশি। অথচ সেখানে নেয়া হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা।’ বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই