যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপেও অক্ষত দাঁড়িয়ে যে ইরাকী নগর

দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমভাগে, ২০০৩ এ মার্কিন আগ্রাসনের পর মূলত লন্ডভন্ড হয়ে যেতে থাকে ইরাক। সেই থেকে আজ অবধি দেশটি এতোখানি পিছিয়েছে যে, পূর্বাবস্থায় ফেরা আগামি দুই শতকেও অসম্ভব হতে পারে। যাহোক। ইরাকের যুদ্ধধ্বস্ত শহর, শিশু আর মৃতদের মিছিল গণমাধ্যমে দেখছে মানুষ বিগত এক দশক ধরে। সুতরাং সে আলাপ থেকে সরে এসে, আজ বর্ণনা করা যেতে পারে এমন এক আনন্দ নগরীর কথা, যেখানে যুদ্ধের শুল কোন এক রহস্যময় উপায়ে এখনও বিদ্ধ হয়নি। সে নগরীর নাম আরবিল।

ইরাকের উত্তরাংশে অবস্থিত কুর্দি শহর আরবিল। নগরীতে চোখে পড়ে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ এবং একাধিক আদিবাসী-অভিবাসী গোষ্ঠি। তারা চমৎকারভাবে শান্তিতে সহাবস্থানের কৌশল শিখে নিয়েছে। রাস্তার দু পাশে চোখে পড়ে সমৃদ্ধ দোকানপাট, উৎফুল্ল দোকানী। মনে পড়ে যেতে পারে সমৃদ্ধতম প্রাচীন বাগদাদের কথা, আরবের না ঘুমোনো হাজার রাতের গল্প যে নগরীর প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে। প্রাচীন বাগদাদই যেন নিজেকে প্রকাশ করছে ইরবিল শহরে। পানাহার চলছে, রেডিওতে বাজছে ললিতকণ্ঠী আরব গায়িকা জোবি ফাতাহর গান। পথে ঘাটে রহস্য ছড়াচ্ছে প্রাচীন দালানের ফেলে রাখা সূঁচালো-বৃত্তাকার ছায়া।

আরবিল শহরের রহস্যময় যুদ্ধহীন বাতাসে শ্বাস নিতে আসেন এমনকি যোদ্ধারাও। পানাহারে, আড্ডায়, কিছুক্ষণের জন্যে অস্ত্র নামিয়ে রাখেন তারা। বিশেষ করে সুন্নি যোদ্ধারা এখানে এসে থাকেন ক্ষণকালীন অবকাশ যাপনের জন্যে, যাদের উদ্ভব মূলত ২০০৬ থেকে ইরান-সিরিয়ার প্রশ্রয়ে নুরি আল মালিকির সুন্নিদমনমূলক নীতির রূঢ় বাস্তবায়ন থেকে। শরীরে ইলেক্ট্রিল ড্রিলের ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ান তারা। কৈশোরে নুরি আল মালিকি ওরফে আবু ইসরার পেশলবাহিনী তা তাদের শরীরে সেঁটে দিয়েছিল।

এই সুন্নিদের অনেকেই ইরাক আক্রমণকারী আইসিসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অস্তিত্ব টেকানো স্বপ্নে। কিন্তু যে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে আইসিসের উত্থান এবং দলটির পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের অদূরবর্তী ভবিষ্যত দখলের পশ্চিমা নীলনকশাকারীদের বিনিয়োগকৃত যে বিপুল পুঁজি; তার কাছে বিচ্ছিন্ন ঐ সুন্নি যোদ্ধারা একান্তই মূল্যহীন। এভাবে কোনদিন তারা হারানো অতীত ফিরে পাবে বলে মনে হয় না। ব্যবহৃতই হয়ে যাবে শুধু, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

কথা ছিল, এক আনন্দ নগরীকে নিয়ে কথা হবে। আরবিল। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে থেকে আলোচিত, দেবী ইসথারের নগরী। এখানে, পশ্চিমের চিরকালীন কৌশল- উসকে দেয়া জাত্যাভিমান, নেই, যা বর্তমানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং এককালে প্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করে ছিল, যার রেশ এখনও টানতে হচ্ছে প্রাচ্যবাসীদের। অথচ ওদিকে, আরবিলে বাহুর কোণে বাহু গলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরব, প্রাচীন অসিরীয়, তুর্কি, আর্মেনীয়, এজিদি, সাবাক ও মান্দিয়ানরা।

এমন ভাতৃত্ব থেকে এ মুহূর্তে মূল ইরাকের শিক্ষা নেয়া উচিৎ, এ কথা ইরাকের যুদ্ধ মাথায় নিয়ে জন্ম নেয়া বারো বছরের কিশোরীটিও জানেন। কিন্তু জেনেও জানেন না যারা, আরব্য রজনীর সাদা রাজহাঁস সপাটে ডানা ঝাপটে তাদের উড়িয়ে দিক।



মন্তব্য চালু নেই