যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জা কিমের ঝলসে যাওয়া মুখ
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সংঘঠিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয়ময়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টানা ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনগণ আধিপত্যবাদিতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে। যুদ্ধের একপক্ষে ছিল উত্তর ভিয়েতনামি জনগণসহ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং অন্যপক্ষে ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামি সেনাবাহিনী ও দোসর মার্কিন সেনাবাহিনী। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামিরা প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধে লড়াই করে ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে। উপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করার পরেই বৃহত্তর ভিয়েতনাম নিয়ে মার্কিনীদের মধ্যে সংশয় শুরু হয়ে যায়। সংময়ের মূল কারণ ছিল, মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মতে যদি সমগ্র ভিয়েতনাম সাম্যবাদী শাসনের অধীনে চলে আসে তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র সাম্যবাদ ছড়িয়ে পড়বে।
আর এই সংশয় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের ঘটনাবলির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নেয়। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদ বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। কিন্তু এই সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের প্রতিবাদে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার পতনের লক্ষ্যে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করা হয়। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন রোধকল্পে সেখানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু এর ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয় তার প্রভাব পরে সাধারণ ভিয়েতনামিদের উপর। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের শিকার হয় অনেক ভিয়েতনামি, আর তাদেরই একজন কিম ফেক।
১৯৭২ সালের কথা, কিম ফেকের বয়স ছিল তখন মাত্র নয় বছর। অতটুকু বয়সেই সে আক্রান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর ছোড়া নাপাম বোমার। সভ্যতা বিবর্জিত সেই বোমার আঘাতে সেদিন পুড়ে গিয়েছিল কিম ফেকের ছোট্টো শরীরটি। তার মুখে জুরে ছড়িয়ে গিয়েছিল তীব্র বেদনাদায়ক যন্ত্রনা আর মিশে ছিল আর্তনাদময় চিৎকার। বোমার আঘাতে শরীর থেকে মাংস পুড়ে যাচ্ছিল, আর এমন অবস্থায় ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে বাঁচার আশায় ছুটছিল কিম। তার সেই যন্ত্রনা নিয়ে ছোটার দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন এসোসিয়েটেড প্রেসের(এপি) নিক উট নামের এক আলোকচিত্রী। ঘটনার পরের দিন, কিমের ঝলসে যাওয়া আলোকিচিত্রটি নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রথমসারির গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই আলোকচিত্রের প্রেক্ষিতেই অবশ্য নিক ডট পরবর্তীতে ‘পুলিৎজার’ পুরষ্কার পান।
ফেক তার স্বামীর সঙ্গে কানাডা থেকে মায়ামির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। সেখানে তিনি মায়ামি ডারমাটোলজি এবং লেসার ইনস্টিটিউট এর অধীনে চিকিৎসাধীন আছে। তারই ধারাবাহিকতায় তার মায়ামি যাওয়া। নাপাম বোমার তীব্রতায় তার ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত এবং বা হাতের অধিকাংশ অংশই পুরে যায়। পুরে যাওয়া অংশের টিস্যুগুলো নরম এবং মলিন করতেই তিনি লেজার চিকিৎসা নেন। ফেকের চিকিৎসক বলেন, লেজার চিকিৎসার ফলে তার ব্যথার উপশম হবে। তবে তার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা কোন অর্থ নেবে না তার কাছ থেকে।
এখন ফেকের বয়স ৫২ বছর এবং উটের বয়স ৬৫ বছর। উট এখনও লস অ্যাঞ্জেলসভিত্তিক এপিতে কাজ করে। কিম ফেক বলেন, উট আমার সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন। সে আমার ছবি তুলে আমাকে একটি নতুন জীবন দিয়েছেন। অপরদিকে এপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফেক বলেন ‘আমার এখন মনে হয় আমার আর এখন কোন ভয় নেই। যদিও আমার সুস্থ হতে অনেক বছর লেগে গেছে তবুও আমি অনেক আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ। আমার এখন পৃথিবীকেই স্বর্গ মনে হয়’।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, যে যুক্তরাষ্ট্রের ছোড়া বোমাতে কিমের এই দশা হয়েছে, আজ সেই যুক্তরাষ্ট্রই কিমের সকল চিকিৎসার ভার নিয়েছে। মানবসভ্যতা এই ঘটনাকে কোন দৃষ্টিকোন দিয়ে দেখবে সেটা ভিন্ন আলাপ হলেও, মানুষ ভুলে যায়নি দীর্ঘবছরের যুদ্ধে এরকম অনেক কিম ফেকের জীবন চলে গেছে স্রেফ যুক্তরাষ্ট্রের খামখেয়ালিতে। কারণ এই লেখার শুরুতেই বলা আছে, স্রেফ সংশয়ের বশবর্তী হয়ে ভিয়েতনামের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং গোটা জনপদের জীবনে ডেকে এনেছিল এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা। তবে আজ হাজারো অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বর্তমানে ফেক এখন অসহায় শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক কিম ফাউন্ডেশন নামে একটি পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছেন। বিনালাভে নির্মিত এই ফাউন্ডেশন থেকে মূলত আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অসহায় শিশুদের সাহায্য করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই