মৃত্যুর মুখে দক্ষিণ সুদানে জীবন যেমন

দক্ষিণ সুদান ১৯৫৫ সালে যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। এরপরও সুষম রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে, মসৃণ পথে এগিয়ে যেতে পারেনি দেশটি। বারবার হোঁচট খেয়েছে। স্বাধীকারের শুরু থেকেই কেন্দ্রের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের রাজনৈতিক ক্ষমতার অসমতা থেকে আসা অসন্তোষপ্রসূত সংঘাত লেগে থাকতো।

১৯৭২ সালে দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর আরও বহু রক্তনদী বহার পর, ২০১১ সালে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভূখণ্ড নিয়ে দারুণ সম্ভাবনাময় দেশটি এবারও মানুষের রক্তে ক্রমশ লাল হয়ে উঠতে থাকে, যতটা রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে, তার চেয়ে বেশি গোষ্ঠীগত প্রাধান্যবিস্তারের লড়াইয়ের কারণে।

২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেশটির প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘাতপর্বের সূচনা ঘটে, যার সূত্র ধরে ১ লাখেরও বেশি মানুষকে ঘরহারা হতে হয়। ১০ হাজারেরও অধিক মানুষকে হারাতে হয় প্রাণ।

২০১৪ দেশটির জন্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাঁকবদলের সময়। সারা ডিসেম্বর ডিঙ্কা ও নুয়ের গোত্রের দুই প্রতিনিধি; রাষ্ট্রপতি সালভা কির ও ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী রিয়েক মাকার; দলবল নিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। তখন নতুন বছর ২০১৪, স্রেফ সেই সংঘাতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গেছে। এবং শেষটায় এক বিচিত্র পরিণতিও দিয়ে গেছে।

জানুয়ারি
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ রাজধানীসহ বাণিজ্য নগরগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সরকারপন্থী সাউথ সুদান লিবারেশন আর্মি। মাকারের বিদ্রোহী দল, সমীকরণিকভাবেই বাণিজ্য নগরী মায়োম দখল করতে চেয়েছিল, কারণ তাতে দলের আর্থিক সচ্ছ্বলতা ভালোভাবেই বজায় রাখা যেত। মায়োমে ব্যর্থ হওয়ার পর কেন্দ্র বেনতিউ দখলের চেষ্টা করে তারা। সেখানেও ছিল লিবারেশন আর্মির জয়জয়কার। জানুয়ারির ১৫ তারিখ নাগাদ শত শহ সাধারণ মানুষ মারা পড়ে দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধে। ২ শতাধিক মানুষ সলীল সমাধি বরণ করে, তারা নীল নদ পেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যেতে চেয়েছিল।

দক্ষিণ সুদানকে কেন্দ্র জাতিসংঘ, আফ্রিকীয় সংঘ কূটনৈতিক তৎপরতায় শামিল হয়। দ. সুদানকে ঘিরে ইথিওপিয়া ও উগাণ্ডার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয়। কোন শহরের দখল কে কার বাহুবলে তুলে নিচ্ছে, সাধারণ মানুষ তা নিশ্চিত হতে গিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করে। শহরগুলো পালা করে দুই পক্ষই দখল, পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শক্তির প্রায় সম উপস্থাপন দুই পক্ষকেই সন্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। ২৩ জানুয়ারি দ. সুদানের হিতাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্র ইথিওপিয়ার মধ্যস্থতায় সরকারপক্ষ ও বিরোধী সশস্ত্র বাহিনী এক অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়। ক’দিন পরই তা ভঙ্গ করা হয়, কোন পক্ষ থেকে প্রথম তা করা হয়েছে, কাদা ছোড়াছুড়ির মহরতে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ফেব্রুয়ারি
গৃহযুদ্ধে পুরোদমে শুরু হয়ে যায় পুনরায়। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকার পক্ষের লিবারেশন আর্মির বারংবার লড়াই বাঁধতে থাকে ইউনিটি স্টেট, আপার নাইল স্টেটএর মতো তেলকূপবহুল এলাকাগুলোয়। কেননা, তেলকূপের মালিকানা হস্তান্তর বড় ধরনের পট পরিবর্তনে চিরকালই সহায়ক, যেমনটা বিগত ৬০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যেও দৃষ্ট হচ্ছে। ১০ ফেব্রুয়ারি শান্তি আলোচনার দ্বিতীয় দফার পূর্বধার্যকৃত তারিখ ভণ্ডুল হয়ে যায়। অনেক বিশ্লেষক বলতে থাকেন, শান্তি আলোচনা ছিল স্রেফ ভাঁওতা। এর ফুরসতে দুই দলই স্রেফ শক্তি সংগ্রহে ব্যস্ত থেকেছে। কারণ ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে কোন দল কখনই এগোয়নি। ডিঙ্কারা একতরফাভাবে যেন তুলনামূলক সংখ্যালঘু নুয়েরদের আজীবন মার দিয়ে যেতে পারে এবং ক্ষেত্রবিভেদে ঠিক উল্টোটা; এ নিয়েই চলছিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বিস্তার।

মার্চ
প্রথমবারের মতো সরকারী বাহিনী লিবারেশন আর্মির মধ্যে অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে, বেতনভাতা নিয়ে। উপযুক্ত বেতনভাতার দাবিতে লিবারেশন আর্মির সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে উর্ধ্বতনদের বচসার জের ধরে একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। কঠোর হাতে এ অন্তর্বিদ্রোহ দূর করা হয়। অতঃপর পুরোদমে শুরু হয় লড়াই। মধ্যবর্তী সময়ে, শান্তি আলোচনার উদ্যোগ আবাওর ব্যর্থ হয়।

s sudan liberaton army কেমন কেটেছে দিন দক্ষিণ সুদানে?

এপ্রিল
গৃহযুদ্ধের নৃশংসতম শিকার মালাকাল কাউন্টি সাধারণ মানুষের জন্যে কসাইখানায় পরিণত হলে সরকারি বাহিনী অস্ত্রবিরতি পালন করতে শুরু করে। এই এপ্রিলেই বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে প্রকাশ্য গণহত্যার রক্ত লেগে যায়। বেনতিউ শহরের শরণার্থী শিবির হিসেবে কাজ চালাতে থাকা স্কুল, মসজিদ ও হাসপাতালগুলোয় গুলি চালিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় বিদ্রোহী মাকারের সশস্ত্র দল। নিহতের সংখ্যা ৩ শতাধিক। বলা হচ্ছিল, এর দুটি কারণ। এক, বেনতিউর অধিকাংশ ছিল ডিঙ্কা গোত্রভুক্ত। ডিঙ্কারা ২০১৩র ডিসেম্বরে এক পুলিশ স্টেশনে ২৪০ নুয়েরকে গণহারে হত্যা করেছিল, তার প্রতিশোধ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়। দুই, লিবারেশন আর্মির সেনারা সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ মানুষের বেশ ধরে আত্মগোপন করে আছে বলে খবর পাওয়ার পর, সন্দেহের বশবর্তী হওয়া মাত্রই হত্যা করা হয়েছে। ২ শতাধিক মানুষ এ সময়ে নিহত হন।

মে
৯ মে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় মুখোমুখি হন যুদ্ধরত দুই নেতা সালভা কির ও রিয়েক মাকার। একটি অস্ত্রবিরতিতে স্বাক্ষর করেন তারা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তা পুনরায় ভঙ্গ করা হয়।

জুন
দক্ষিণ সুদানের মানুষ ইতোমধ্যে সব বিবদমান দুটি দলের ওপর থেকে সকল ভরসা তুলে নিয়েছে। আর সে ভরসাতেই, যুদ্ধে বিরতি দিয়ে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ার সমঝোতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় যুদ্ধবিরতি আবার ভঙ্গ করা হয়।

জুলাই
অবিচ্ছিন্ন রক্তের ধারায় ভাসলো নীলনদ।

অগাস্ট
অল্প দিনের ব্যবধানে জাতিসংঘের দুইটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা হয়। প্রথমবার ভূলক্রমে ওটাকে সরকারী আকাশযান মনে করে গুলি করে বিদ্রোহীরা, পিতর গাদেতের নির্দেশে। দ্বিতীয় হামলাটি চালানো ত্রাণবাহী কার্গো হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে। এতে ৩ রুশ জাতিসংঘকর্মী নিহত হন।

সেপ্টেম্বর
রিয়েক মাকারের সশস্ত্র বিদ্রোহী দল ক্রমশ শক্তি হারাতে থাকে। অপরদিকে সরকারপক্ষীয় সেনাবাহিনী লিবারেশন আর্মিও যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাদের অবস্থান ছিল ‍তুলনামূলক উত্তম।

অক্টোবর
দেশের প্রধানতম শহর ও তেলকূপগুলোয় সরকারী প্রতিনিধিত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিঙ্কারা পুনরায় বেনতিউ শহর আক্রমণ করে, কিন্তু লিবারেশন আর্মির প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে।

এভাবেই আপাতত চেপে রাখা হয়েছে হিংসার অঙ্কুরোদগম। যেহেতু বীজ রয়ে গেছে এখও ডিঙ্কা ও নুয়েরদের মনে, প্রতিশোধের আগুন আবারও জ্বলে উঠতে পারে যে কোন সময়ে, বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দেশটিতে।

s sudan national কেমন কেটেছে দিন দক্ষিণ সুদানে?



মন্তব্য চালু নেই