মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে কী করেছিলেন হিটলার

অ্যাডলফ হিটলার গানশুটে আত্মহত্যা করে মারা যান। তার আত্মহত্যার দিনটি ছিল ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। আর আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে বার্লিনের ফুয়েরার বাংকারে। ফুয়েরার বাংকারটি প্রথম দিকে গড়ে তোলা হয়েছিল সাময়িকভাবে, বিমান হামলার সময় আশ্রয় নেয়ার জন্য।

পরে যখন বার্লিনে বিমান হামলা বেড়ে গেল, তখন এর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে একে হিটলারের স্থায়ী আশ্রয়স্থলে রূপ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ফুয়েরার বলতে আমরা হিটলারকেই বুঝি। ফুয়েরার হিটলারের নামের কোনো অংশ নয়, এটি ছিল তার একটি উপাধি। ফুয়েরার একটি জার্মান শব্দ। এর অর্থ লিডার বা গাইড। বার্লিনের এই ভূগর্ভস্থ ফুয়েরার বাংকার নির্মিত হয় দু’টি পর্বে। প্রথম পর্ব ১৯৩৬ সালে। দ্বিতীয় পর্ব ১৯৪৩ সালে।

অ্যাডলফ হিটলার এ বাংকারে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি থেকে। তখন থেকেই এই বাংকারটি হয়ে ওঠে জার্মান নাৎসি সরকারের মূল কেন্দ্র। হিটলার সেখানেই ছিলেন আত্মহত্যার আগে পর্যন্ত। এ বাংকারেই আত্মহত্যার ৪০ ঘণ্টা আগে হিটলার বিয়ে করেন ইভা ব্রাউনকে। বলা যায় বিয়ের পরপরই এরা দু’জন আত্মহত্যা করেন।

ইভা ব্রাউন পলা হিটলারের জন্ম ১৯১২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। হিটলারের সাথে আত্মহত্যা করে মৃত্যু ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। ছিলেন হিটলারের দীর্ঘ দিনের সাথী ও মাত্র ৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য হিটলারের স্ত্রী। হিটলারের সাথে ইভার দেখা হয় মিউনিখে। তখন ইভার বয়স ১৭। ইভা তখন কাজ করতেন হিটলারে পার্সোনাল ফটোগ্রাফারের সহকারী ও মডেল হিসেবে।

এর দুই বছর পর থেকে হিটলার ও ইভার মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো নিয়মিত। তাদের প্রাথমিক সম্পর্কের সময়ে ইভা দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৩৬ সালের পর থেকে হিটলারের বার্গহফ নামে বাড়িতেই বসবাস করতে শুরু করেন। হিটলারের এই বাড়ি ছিল জার্মান ব্যাভারিয়ান পর্বতশৃঙ্গের বার্খটেসগার্ডেন মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায়। বলা যায়, তখন থেকে তিনি হয়ে ওঠেন হিটলারের জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তখন তিনি সব দিক বিবেচনায় অভিজাত এক জীবন যাপন করেন।

ইভার এমন কিছু অভ্যাস ছিল যাতে হিটলারের সায় ছিল না। ইভা ধূমপান করতেন। উগ্র মেকআপে অভ্যস্ত ছিলেন। নগ্ন রোদস্নানে যেতেন। ফটোগ্রাফি ছিল তার ভারী উপভোগের বিষয়। তার তোলা হিটলারের অনেক স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র এখনো দেখতে পাওয়া যায়। হিটলারের ঘনিষ্ঠ লোকদের মধ্যে ইভা ছিলেন অন্যতম মুখ্যজন। কিন্তু কখনোই সাধারণ্যে আসতেন না। সার্বজনীন আয়োজনে উপস্থিত হতেন না। তবে ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মে তার বোন গ্রেটল যখন এসএস ফোর্সের একজন লিয়াঁজো অফিসারকে বিয়ে করেন, তখন সে অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে।এসএস ফোর্স ছিল হিটলারের একটি বহুজাতিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে গঠিত বাহিনী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে যখন থার্ড রাইখের পতন ঘটল, তখনো হিটলারের প্রতি ইভার আনুগত্য ছিল প্রবল। উল্লেখ্য, ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নাৎসি জার্মানি দেশটি থার্ড রাইখ নামেই সাধারণত পরিচিত হতো। সে সময়ে হিটলার ও তার নাজি পার্র্টি দেশটিতে চালু রাখে টোটালিটারিয়ান ডিকটেটরশিপ। যা-ই হোক থার্ড রাইখের পতন হয়েছে জেনেও ইভা চলে যান বার্লিনে। হিটলারের পাশে থাকার মানসে। গিয়ে সোজা ওঠেন ফুয়েরার বাংকারে।

এ বাংকারটি ছিল রাইখ চ্যান্সেলারির নিচের ভূগর্ভে। ১৯৪৫ সালের ২৯ এপ্রিল যখন রেড আর্মি আশপাশে যুদ্ধরত, তখন ইভা সংক্ষিপ্ত আয়োজনে বিয়ে করেন হিটলারকে। তখন তার বয়স ২৯। আর হিটলারের ৫৬। এর ৪০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে তিনিও আত্মহত্যা করেন হিটলারের সাথে।

হিটলার ও ইভার আত্মহত্যার পর ওই দিন বিকেলে হিটলারের পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী বাংকারের ইমার্জেন্সি এক্সিট পথে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে তুলে আনা হয়। বাংকারের বাইরে রাইখ চ্যান্সেলারি গার্ডেনে নিয়ে লাশ দু’টিতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সোভিয়েত আর্কাইভ রেকর্ড মতে, তাদের পোড়ানো দেহাবশেষ পুনরুদ্ধার করে বেশ কয়টি জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। ১৯৭০ সালে তা তুলে এনে আবার পোড়ানো হয়। এরপর পাওয়া ছাইভস্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিঃশেষ করে দেয়া হয়।

তার আত্মহত্যা কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মত। কেউ বলছেন তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। কেউ বলেছেন তিনি নিজের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। কেউ বলেছেন হিটলার সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে অনেক কষ্ট করে মারা যান। সমসাময়িক ইতিহাসবিদেরা অবশ্য তার মৃত্যুর এ বিবরণ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন হয় এটি নিছক একটি সোভিয়েত অপপ্রচার, নয়তো এটি বিভিন্ন মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের একটি প্রয়াস মাত্র। প্রত্যক্ষদর্শীর একটি সাক্ষ্যও রয়েছে। এ সাক্ষ্য মতে, হিটলারের মুখে গুলির আঘাত লাগে। তবে এর কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া মাথার যে খুলি ও চোয়াল সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে তাও সত্যি-সত্যি হিটলারের কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এর বাইরে হিটলারের দেহভষ্ম কোথায় কোথায় ছড়ানো হয়েছে, সে ব্যাপারেও বিভিন্ন ইতিহাস উৎস বিশ্লেষণে একমত হওয়া যায় না।

পূর্ববর্তী ঘটনাবলি
১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে অগ্রগামী সোভিয়েত বাহিনীর হাতে পোল্যান্ডের পতন হয়। এখানে কার্যত যুদ্ধ চলে ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী কুস্ট্রিন ও ফ্রাংকফুর্টের মধ্যবর্তী ওডার নদী পারি দিচ্ছিল। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল বার্লিনের ৪০ মাইল তথা ৬৪ কিলোমিটার পূর্বে। পশ্চিম দিকে হিটলার বেলজিয়ামের আরডেনিস পর্বতাঞ্চলে যে অগ্রগামী বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, মিত্রবাহিনীর হাতে তারও পরাজয় ঘটেছে। উত্তর দিকে ব্রিটিশ ও কানাডীয় বাহিনী রাইন নদী পারি দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে জার্মান শিল্পাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র রুহরে।

দক্ষিণে আমেরিকান বাহিনী দখল করে নিয়েছে লরেইন। লরেইন হচ্ছে ফ্রান্সের ২৬টি প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি। লরেইন দখল করে এরা এগিয়ে যাচ্ছিল জার্মান নগরী মেইনঝ, মেনহেম ও রাইনের দিকে। ইতালিতে জার্মান বাহিনী উত্তর দিকে পিছু হটছিল। কারণ, এরা অব্যাহতভাবে চাপের মুখোমুখি হচ্ছিল আমেরিকান ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথ বাহিনীর পক্ষ থেকে। এ বাহিনী বসন্তকালীন হামলার অংশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল পো নদী পারি দিয়ে ইতালি ও অস্ট্রিয়ার পর্বতমালার পাদদেশে পৌঁছার জন্য। সামরিক হামলার পাশাপাশি ৪-১১ ফেব্রুয়ারি সময়ে মিত্র বাহিনীর নেতারা ইয়াল্টায় বৈঠকে বসেন ইউরোপে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার উপায় উদ্ভাবনের জন্য।

হিটলার পিছু হটেন ১৯৪৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ফিরে যান ফুয়েরার বাংকারে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ব্যাপকভাবে এলোমেলো হয়ে পড়া থার্ড রাইখের বৈঠক বসে হিটলারের সভাপতিত্বে। নাজি পার্টির নেতাদের কাছে তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায়, বার্লিনের যুদ্ধই হবে শেষ যুদ্ধ। ইতোমধ্যেই ১ এপ্রিলে আমেরিকান বাহিনী এলবি নদীতে গিয়ে পৌঁছেছে। অপর দিকে স্ট্যালিন চুক্তির প্রতি আস্থা হারিয়ে ইয়াল্টায় গিয়ে পৌঁছে আইজেনহাওয়ারকে বলেন, তিনি বার্লিনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এবং তিনি হামলা চালাবেন ১৯৪৫ সালের মে মাসে। তা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, বার্লিন বিজয় হবে ১ মের আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসের আগে। এবং তিনি তার বাহিনীকে অনুমোদন দিয়েছেন ১৬ এপ্রিলে সিলো উপত্যকায় হামলা চালানোর জন্য।

এই উপত্যকাটিই ছিল শহরের বাইরে বার্লিনের সর্বশেষ বড় ধরনের ডিফেন্স লাইন। ১৯ এপ্রিলের মধ্যে জার্মানরা সিলো উপত্যকা থেকে পুরোপুরি পিছু হটে। ২১ এপ্রিল রেড আর্মি বার্লিনের বাইরের চার পাশে গিয়ে পৌঁছে। সোভিয়েত আর্টিলারির গোলা আগের দিন সন্ধ্যায়ই বার্লিন শহরে গিয়ে পড়তে শুরু করে। ২২ এপ্রিলে বিকেলে ফুয়েরার বাংকারে বসে সিচুয়েশন কনফারেন্স। তখন তার কাছে খবর আসে, আগের দিন এসএস ফোর্স জেনারেল ফেলিক্স মার্টিন জুলিয়াস স্টিনারকে টেম্পরারি মিলিটারি ইউনিট ‘আর্মি ডিটাচমেন্ট স্টিনার’-কে বার্লিন রক্ষার জন্য বার্লিনে মুভ করার যে আদেশ দিয়েছিলেন, সে আদেশ পালিত হয়নি। এ খবরে হিটলার খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। তখনই হিটলার খোলাখুলি ঘোষণা দেন ‘দ্য ওয়ার ইজ লস্ট’। আর এ পরাজয়ের জন্য তিনি দায়ী করেন জেনারেলদের। হিটলার বললেন, তিনি শেষ পর্যন্ত বার্লিনেই থাকবেন এবং এরপর নিজের গুলিতেই আত্মহত্যা করবেন।

পরদিন তিনি এসএস চিকিৎসক ড. ওয়র্নার হ্যাসির কাছে জানতে চান আত্মহত্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি কোনটি। ড. ওয়ার্নার তাকে জানান ‘পিস্তল-অ্যান্ড-পয়েজন মেথড’ হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আত্মহত্যা পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সারকথা হচ্ছে, এক ডোজ সায়ানাইড সেবন আর সেই সাথে মাথায় গুলি করা।

২৫ এপ্রিলের মধ্যে রেড আর্মির বার্লিন ঘিরে ফেলা সম্পন্ন হয়। হিটলারের প্রতিরোধ ইউনিটের সাথে নিরাপদ রেডিও যোগাযোগ অচল হয়ে পড়ে। ফুয়েরার বাংকারের কমান্ডিং স্টাফ আদেশ-নির্দেশ দেয়ার জন্য টেলিফোনের ওপর এবং খবরের জন্য পাবলিক রেডিওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ২৮ এপ্রিল রয়টার্স সূত্রের একটি খবর পরিবেশন করে বিবিসি। এ খবরের একটি কপি সুপরিচিত নাৎসি কর্মকর্তা বোরমান ও আরেকটি কপি এসএস কর্মকর্তা লিন্জকে দেয়া হয় হিটলারের কাছে পৌঁছানোর জন্য। এ খবরে বলা হয়, রাইখ ফুয়েরার-এসএস হিমলার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাব পশ্চিমা জোট প্রত্যাখ্যান করেছে। এ প্রস্তাবে হিমলার ধারণা দেন, এ আত্মসমর্পণ কার্যকর ও বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব রয়েছে। হিটলার মনে করেন, এটি এক ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহ বা বিশ্বাসঘাতকতা। বিকেলের দিকে হিমলারের প্রতি তার রাগ ও তিক্ততা ক্ষিপ্ততায় রূপ নেয়। হিটলার ক্ষিপ্ত হয়ে হিমলারকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। সেই সাথে বার্লিনে হিটলারের সদর দফতরে হিমলারের এসএস রিপ্রেজেনটেটিভ হারমান ফেজেলিনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।

২৯ এপ্রিল মধ্যরাতের পর হিটলার বিয়ে করেন ইভা ব্রাউনকে। এ বিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল ছোট আকারের একটি সিভিল সেরিমোনি। বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ফুয়েরার বাংকারের একটি মানচিত্র কক্ষে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ অ্যান্টনি জেমস বিভর বলেছেন, বিয়ের পর হিটলার তার নতুন স্ত্রীর সাথে পরিমিত নাশতা সেরে নেন। হিটলার তখন তার সেক্রেটারি ট্রাউডল জানজিকে নিয়ে অন্য একটি কক্ষে যান। সেখানে হিটলার তার ‘লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্ট’ রচনার ব্যাপারে সেক্রেটারিকে ডিকটেশন দেন। তিনি এই দলিলপত্র স্বাক্ষর করেন বিকেল ৪টায়। এরপর অন্য একটি কক্ষে গিয়ে বিছানায় বিশ্রাম নেন। কোনো কোনো সূত্র মতে, হিটলার তার ‘লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্ট’ বিষয়ে ডিকটেশন দেন বিয়ের ঠিক আগে। কিন্তু অন্য সব সূত্রই এই দলিল স্বাক্ষরের সময়ের ব্যাপারে একমত।

২৯ এপ্রিলেই হিটলার জানতে পারেন তার মিত্র বিনিটো মুসোলিনির মৃত্যুর খবর। দলীয় কুচক্রীদের হাতে তিনি মারা যান। মুসোলিনি ও তার স্ত্রী কারা পেটেসিকে ফাঁসি দিয়ে তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর লাশ কেটে গর্তে ফেলে রাখা হয়। সেখানে গিয়ে প্রতিশোধপরায়ণ ইতালীয়রা তাদের প্রতি গালাগাল ছুড়ে মারে। সম্ভবত এসব ঘটনাবলি হিটলারের মধ্যে এমন মনোভাব জোরালো হয়ে ওঠেÑ তিনি ও তার স্ত্রীকে এমন ‘ধ ংঢ়বপঃধপষব ড়ভ’ তথা দর্শনীয় কিছুতে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। ওই দিন বিকেলে হিটলার হিমলারের এসএস সূত্রে পাওয়া সায়ানাইড সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

এ ক্যাপসুলের কার্যক্ষমতা পরীক্ষার জন্য হিটলার ড. ওয়ার্নার হ্যাসিকে আদেশ দেন তা ব্লন্ডি নামের জার্মান শেফার্ড কুকুরের ওপর প্রয়োগ করতে। এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হলে কুকুরটি মারা যায়। এই দিন বিকেলে ফুয়েরার বাংকারে বসে হিটলারের ফাইনাল ব্যাটেল কসফারেন্স। সেখানে জেনারেল উইডলিং জার্মানদের করুণ যুদ্ধচিত্র তুলে ধরেন। সেই সাথে বলেন, অপরিহার্যভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বার্লিন যুদ্ধের অবসান ঘটবে। হিটলারের চোখেমুখে তখন নিয়তির ছাপ পুরোপুরি। তিনি পরাজয় মেনে নিয়ে সৈনিকদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যেত বলেন। তবে কিছুতেই আত্মসমর্পণ নয় বলে জানিয়ে দিলেন। ১টার সময় জেনারেল কিটেল জানালেন, যেসব বাহিনীর ওপর হিটলার তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা ব্যাপারে প্রত্যাশা করছিলেন, এর সবই হয় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে নয়তো বাধ্য হয়ে নিজেদের রক্ষার যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

সুইসাইড
আগেই বলা হয়েছে হিটলার ও ইভা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ফুয়েরার বাংকারে অবস্থান করেন ৪০ ঘণ্টারও কম। ৩০ এপ্রিলের সকালের শেষ দিকে সোভিয়েতরা ফুয়েরার বাংকার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে। তখন হিটলার বৈঠক করেন বার্লিন ডিফেন্স এরিয়া কমান্ডার জেনারেল হেলমুট উইডলিংয়ের সাথে। তিনি হিটলারকে জানান, সম্ভবত আজ রাতের মধ্যেই বার্লিন গ্যারিসনের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাবে। উইডলিং তখন হিটলারের কাছে পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এর আগে এ অনুমতি চেয়ে তিনি ব্যর্থ হন। হিটলার প্রথমে এর জবাব দেননি। উইডলিং ব্যান্ডলারব্লক প্রাসাদে তার সদর দফতরে ফিরে যান। সেখানেই তিনি রাতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার অনুমতি পান। হিটলার, তার দুই সেক্রেটারি এবং তার ব্যক্তিগত পাচক দুপুরের খাবার খান। খাওয়ার পর হিটলার ও ইভা বাংকারে তার ব্যক্তিগত স্টাফদের বিদায় দেন। এদের মধ্যে ছিল গোয়েবলসের পরিবারের সদস্যবর্গ, মার্টিন বোরমান, সেক্রেটারিরা এবং বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা। বেলা ২টা ৩০ মিনিটে হিটলার ও ইভা হিটলারের ব্যক্তিগত পড়ার ঘরে যান।

পরবর্তী সময়ে অনেকেই এমন সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, এরা বেলা ৩:৩০-এর দিকে গানশুটের আওয়াজ শুনেছেন। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর হিটলারের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ভৃত্য হেনজ লিনজ বোরমানকে সাথে নিয়ে ছোট্ট পড়ার ঘরের দরজা খোলেন। লিনজি পরবর্তী সময়ে বলেছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ পোড়া খোসা ছাড়ানো বাদামের গন্ধ পান, যা প্রুসিক অ্যাসিড অর্থাৎ জলীয় ধরনের হাইড্রোজেন সায়ানাইডের উপস্থিতিই প্রমাণ করে। হিটলারের এসএস অ্যাডজুটেন্ট স্টামবার্নফুয়েরার অটো গুনশ্চি হিটলারের পড়ার ঘরে ঢুকে একটি সোফার ওপর হিটলার ও ইভার প্রাণহীন দেহ দেখতে পান। হিটলারের পায়ের কাছে পড়ে ছিল তার নিজের পিস্তল। এটি ছিল একটি ‘ওয়াল্টার পিপিকে ৭.৬৫ মিমি’ পিস্তল। ধরে নেয়া হয় হিটলার তার নিজের পিস্তল দিয়েই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তবে …

রোকাস মিশ্চ বলেছেন, হিটলারের মাথাটি পড়ে ছিল তার সামনের টেবিলেই। আর তার কপালের ডান পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। আর থুতনির রক্তে অনেকটা লাল হয়ে গেছে সোফার ডান হাতল। কিছুটা রক্ত ঝরে পড়ছিল মেঝেতে/কার্পেটে। ইভার শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন ছিল না। লিনজের কথা মতে, তার মুখই জানিয়ে দেয় ইভা কিভাবে আত্মহত্যা করেন। সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মহত্যা করেন। এসএস অ্যাডজুটেন্ট অটো গুনশ্চি ও মংকে একইভাবে বলেছেন, বাইরের লোক এবং যারা বাংকারে কাজ করছিলেন কিংবা ডিউটিতে ছিলেন তাদের কাউকেই আত্মহত্যার চূড়ান্ত সময়টায় ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ সময়টা ছিল বিকেল ৩টা থেকে ৪টা।

গুনশ্চি পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে ঘোষণা দেন ফুয়েরার মারা গেছেন। এরপর লাশ দু’টি রাইখ চ্যান্সেলারি তথা মন্ত্রীদের দফতরের পেছনের বাগানে নেয়া হলো। বাগানটি ছিল বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত। সেখানেই লাশ দু’টিতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রথমবার লাশে আগুন ধরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। লিনজ আবার বাংকারের ভেতরে যান। সেখান থেকে ভারী কাগজের রোল নিয়ে আসেন। বোরমান কাগজে আগুন ধরিয়ে মশালটা লাশের ওপর ছুড়ে মারেন। যখন লাশ দুটো জ্বলতে শুরু করল তখন বাংকারের দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে বোরমান, গুনশ্চি, লিনজ ও গোয়েবলসসহ একটি ছোট্ট দল হাত তুলে লাশ দু’টিকে স্যালুট করল। বিকেলের দিকে মাঝে মধ্যে রাইখ চ্যান্সেলারির আশপাশে সোভিয়েত বাহিনীর গোলা এসে আঘাত হানছিল। এসএস গার্ডরা আরো পেট্রলপাত্র নিয়ে আসে লাশ দু’টিকে আরো পোড়ানোর জন্য। লিনজ পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করেন, খোলা জায়গায় লাশ পোড়ানোর কারণে লাশের সবখানে সমান তাপ লাগেনি। ফলে লাশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। লাশ পোড়ানোর কাজ চলে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। সাড়ে ৬টার পর লাশের অবশেষটুকু বোমা বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগভীর গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

এরপর
হিটলারের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে রেড আর্মি প্রবল বোমাবর্ষণ শুরু করে। হিটলারের মারা যাওয়ার আভাস প্রথম বাইরের দুনিয়াকে দেয় জার্মানরা নিজেরাই। তৎকালের জার্মানের দীর্ঘ দিনের শক্তিশালী রেডিও স্টেশন ছিল Deutschlandsender, যার অর্থ ‘জর্মন ট্রান্সমিটার’। এরই অংশ ‘রাইখসসেন্ডার হামবুর্গ’ তাদের স্বাভাবিক সম্প্রচার বন্ধ করে ঘোষণা দেয় শিগগিরই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসছে। এরপর হিটলারের স্বঘোষিত উত্তরাধিকারী অ্যাডমিরাল ডোয়েনিটজ এ বেতারে জার্মান জনগণের প্রতি আহ্বান জানান শ্রদ্ধা জানাতে, যিনি রাইখ রাজধানীতে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন ডোয়েনিটজ এ-ও বলেন, তার একমাত্র লক্ষ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যাতে অগ্রসরমান বলশেভিস্ট শত্রুদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে জার্মানকে রক্ষা করা।

সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট SMERSH-এর একটি ইউনিট ২ মে হিটলার, ইভা এবং ব্লন্ডি ও ওউলফ নামে দুই কুকুরের দেহাবশেষ একটি বোমার আঘাতে সৃষ্ট গর্তে আবিষ্কার করে। ময়না তদন্তে গানশুটে হিটলারের মাথার খুলি ও চোয়ালের টুকরো অংশ পাওয়ার কথা রেকর্ড করা হয়। এই ইউনিট বার্লিন থেকে মেগদেবুর্গে স্থানান্তরের সময় হিটলার ও ইভার দেহাবশেষ বার কয়েক মাটিতে পুঁতে রাখা হয় এবং আবার তা মাটিখুঁড়ে তোলা হয়। শেষ পর্যন্ত এদের লাশ ও হিটলারের প্রপাগান্ডা মিনিস্টার জেসেফ গোয়েবলস, তার স্ত্রী ম্যাগদা গোয়েবলস ও তাদের ছয় শিশুসন্তানের লাশ অচিহ্নিত এক কবরখানায় পুঁতে রাখা হয়। কোথায় তাদের কবর দেয়া হলো সে বিষয়টি অতি গোপন রাখা হয়।

১৯৬৯ সালে সোভিয়েত সাংবাদিক লেভ বেজিমেনস্কির SMERSH-এর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সম্পর্কিত একটি বই প্রকাশিত হয় পাশ্চাত্যে। কিন্তু পূর্ববর্তী ভুল তথ্য দেয়া চেষ্টার ফলে ইতিহাসবিদেরা এ বইয়ের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করেননি। ১৯৭০ সালে কেজিবি নিয়ন্ত্রিত স্মার্শ ফ্যাসিলিটি পূর্ব জার্মানি সরকারের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নির্ধারিত হয়। কেজিবি তখন আশঙ্কা করে ১৯৪৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে হিটলারের লাশ পুঁতে রাখার স্থানটি চিহ্নিত হয়ে পড়লে সে স্থানটি জার্মানদের তীর্থস্থানে রূপ নিতে পারে। সে আশঙ্কায় কেজিবি ডিরেকটর ইউরি আদ্রেঁপভ হিটলার ও ইভার দেহাবশেষ চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেয়ার অপারেশন অনুমোদন করেন। সোভিয়েত কেজিবি টিমকে কবরের বিস্তারিত চার্ট দেয়া হলো। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল গোপনে মাটিখুঁড়ে বের করে আনা হলো পাঁচটি কাঠের বাক্স। এগুলোর মধ্যে ছিল ১০ কিংবা ১১টি লাশের অবশেষ। এগুলোর বেশির ভাগই ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। দেহাবশেষগুলো ব্যাপকভাবে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হলো। এরপর এর ছাইভস্ম জার্মানির এলবি নদীর উপনদী বিটারিটজ্ নদীর পানিতে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। আর এভাবেই শেষ হয় হিটলারের রহস্যময় মৃত্যু উপাখ্যান। তার পরও প্রশ্ন থাকে, এ উপাখ্যানের এখানেই কি শেষ?-অন্য দিগন্ত



মন্তব্য চালু নেই