‘মা, আমার রক্তমাখা ব্যাগটা ধুয়ে দাও’
‘দয়া করে আলোটা নিভিয়ে দিন। আমার ভাই একটু আগেই ঘুমিয়েছে’। হাসপাতালের সাত নম্বর ওয়ার্ড যেখানে অনেক আহত শিশুকে রাখা হয়েছে তার আলো জ্বালতেই ওয়াকার আমিন নামের একজন এই কথাগুলো আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন। কথাগুলো খুব সাধারণ হলেও এর মাঝে কিছু একটা ছিল, যে কারণে আমরা লাইট বন্ধ করে চলে গেলাম।
গত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি সেনানিয়ন্ত্রিত স্কুলে বন্দুকধারীরা হামলা চালায়। এই ঘটনার দুইদিন পর আমি পেশোয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে ওয়াকার আমাদের জানায় যে, তার দুই ভাই আর্মি পাবলিক স্কুলে পড়তো এবং তারা দুজনেই বন্দুকধারীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। একজনের কোমরে ও অন্যজনের মাথায় গুলি লেগেছে। ওয়াকার নিজে একজন পুলিশ কনস্টেবল, আর তার বাবা-মা অন্য দুই সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় তাদের আর্মি পাবলিক স্কুলে পাঠিয়েছিল। এই হামলার আগে পর্যন্ত পাকিস্তানের কেউই এটা অনুমান করতে পারেনি যে তাদের সন্তানরা এভাবে আক্রমনের শিকার হবে। তাও আবার পেশোয়ারের মতো শহরের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকায়।
আর্মি পাবলিক স্কুলে যখন তালেবান বন্দুকধারীরা প্রবেশ করে তখন ওয়াকারের এক ভাই তাকে ফোন করে সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে জানায়। প্রচণ্ড ভীত কণ্ঠে ওয়াকারকে তার ভাই জানাচ্ছিল যে স্কুলের পেছনে ভারি গুলিবর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু এই কথা বলতে বলতেই বন্ধ হয়ে যায় ফোন। তখন ওয়াকার তার ভাইদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মকিতা কাটিয়ে যখন তিনি স্কুলে পৌঁছান তখন দেখতে পান, স্কুলের নিরাপত্তাকর্মীরা অসহায়ের মতো সাহায্যের আশায় দাড়িয়ে আছে। সবাই দাড়িয়ে শিশুদের গুলিবিদ্ধ শরীর লুটিয়ে পড়তে দেখছিল। এ এমন এক পরিস্থিতি যখন চাইলেও কিছু করার উপায় নেই।
‘আমার ভাইয়ের ফোন কেটে যাওয়ার পর আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি ওর ফোনে। শেষমেষ যখন পেলাম তখন আমার ভাই জানালো যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তার চারপাশে শুধু মৃতদেহ। তবে তার এক বন্ধু তখনও জীবিত ছিল। এসব কথা বলার মাঝেই আমার ভাই জানালো যে কেউ একজন আসছে তাই কথা বলা যাবে না। কিছুক্ষন পর আবারও কথা হয় ভাইয়ের সঙ্গে। ও আমাকে জানালো যে, সন্ত্রাসীরা মৃতদেহের ঘাড়ে বন্দুকের উত্তপ্ত নল ঠেকিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল যে, কেউ জীবত অবস্থায় মৃতের ভান করে আছে কিনা। কেউ বিন্দুমাত্র শব্দ করলেই তাকে আবারও গুলি করা হচ্ছে। আমার ভাই তার মোবাইল সাইলেন্ট করে মৃতের মত পড়ে থাকে। তার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছিল বলে তাকে আর পরীক্ষা করে দেখেনি। এক পর্যায়ে ও আমাকে বললো, আমি যেন ওকে বাঁচাতে স্কুলে না আসি। আমি আসলে আমাকেও হত্যা করবে সন্ত্রাসীরা।’
কয়েকঘণ্টা ধরে আক্রমণকারী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বেড়াল-ইঁদুর খেলা চলছিল। শেষমেষ সেনাবাহিনী স্কুলকে সন্ত্রাসীমুক্ত ঘোষণা দিল। ওয়াকার সেনা সদস্যদের অনুরোধ করতে লাগলেন স্কুলের ভেতরে যাওয়ার জন্য, যদিও সেনাসদস্যরা তাকে বোঝাচ্ছিল যে এটা ঝুঁকিপূর্ণ। সে তখন অ্যাম্বুলেন্সকর্মীদের একটি হেলমেট জোগাড় করে এবং স্কুলে ঢোকার অনুমতি পায়। ওয়াকারের ভাষ্যমতে, স্কুলের পুল ছিল রক্তাক্ত। বিভিন্ন স্থানে শিশুদের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। খেলার মাঠে ক্রীড়ারত শিশুদের ওই অবস্থাতেই গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি যখন তার ভাইকে খুঁজে পান তখন তিনি দেখতে পান একজন সৈনিক তার ভাইকে সাহায্য করছে।
হাসপাতালের করিডোরগুলো সবসময়ই বিষণ্ন আর মন খারাপের অনুভূতির জন্ম দেয়। এই হাসপাতালে যত মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে সবারই এক কথা যে মানুষ কি করে এরকম বর্বরোচিত কাজ করতে পারে। যারা নিজেদের ইসলাম ধর্মের রক্ষক দাবি করে তারা কিভাবে এই কাজটি করতে পারে। আর্মি পাবলিক স্কুলটিতে গেলে এখনও মৃতের গন্ধ পাওয়া যায়। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালগুলো একটাও আস্ত নেই, গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে গেছে সব। গোটা পাকিস্তানে এখন শোকের মাতম। যে শিশুরা মারা গেছে তাদের পরিবার আজ অসহায়, আর যেসব শিশু এই বীভৎস অভিজ্ঞতার মাঝেও বেঁচে আছে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রনা, ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা তারা ক্রমশ আক্রান্ত হচ্ছে। পাকিস্তানের একটি স্থানীয় পত্রিকায় নাম না জানা এক কবি এই ঘটনা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। যে কবিতায় পাকিস্তানের অগুনতি মানুষের হৃদয়বেদনা মিলেমিশে একাকার-
তাকিয়ে দেখো, আমার ব্যাগ রক্তে ভিজে গেছে
বইগুলো সব, এখন লাল হয়ে আছে
ওরা হারিয়ে গেছে সব, অতীতের ছবি হয়ে গেছে
আমার সঙ্গে যে কী ঘটেছে, কতটা দীর্ঘসময় নিয়ে তা বলা যায়?
মায়ের কোল থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল,
অতঃপর পাঠঘরের জ্ঞানসমুদ্রে স্নান
হঠাৎ স্কুলের ঘণ্টার শব্দ দখল করে নিল, বোমার বিকট শব্দ
চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ছুটে আসছে বুলেট!
সময় যে কতটা দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল, কী বলবো তোমাকে
সেই প্রবল শোরগোলে, একজনকে দেখতে পেলাম হঠাৎ
অসভ্য বর্বরটার কাঁধে বন্দুক ঝোলানো ছিল
ধর্মের ছদ্মবেশধারী ঘৃণার সে দূত এগিয়ে আসছিল ক্রমে,
নিরস্ত্র ছেলেদের ঘরে ঢুকে অতঃপর, যেন যুদ্ধ ঘোষণা করলো
বন্দুকের নল দুলিয়ে দুলিয়ে, বললো,
‘লাইনে দাঁড়াও সব!
এরপর… দেয়াল রাঙানো হলো আমাদের রক্তে
আমার জন্য গর্বিত হয়ো মা,
আমার মাথায় গুলি লেগেছে
এখন আমার কোনো ভয় নেই, কোনো সংশয় নেই
তাকিয়ে দেখো একবার,
যে কপালে চুমু দিয়ে তুমি বিদায় জানাতে
সে কপালে এখন গুলির ক্ষত, রক্তে ঢেকে গেছে
তোমার শেষ কথাগুলো মনে পড়ছে, মা
সকালে যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, বলেছিলে,
‘দুপুরের খাবার খেতে ভুলিস না বাবা!’
তুমি তো জানতে না যে, ওটাই ছিল আমার শেষ প্রাতঃরাশ
স্রষ্টাই আমার সময় বেঁধে দিয়েছেন
এখন আমি বন্ধুদের সাথে আছি, খাবোও তাদেরই সঙ্গে
দয়া করে আমার জন্য ভেবো না, আমাকে ভুলেও যেও না
তাকিয়ে দেখো, আমার ব্যাগ যে রক্তে ভেজা…
মন্তব্য চালু নেই