মালালার কাছে নাবিলার হার

২০১২ সালের ২৪ অক্টোবর। পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের এক ছোট্টো গ্রামে নিজের বাড়ির উঠোনে খেলছে আট বছর বয়সী নাবিলা রেহমান। পাশেই তার দাদী মোমেনা বিবি তাকে আর তার ছোটো ভাইকে দেখাচ্ছিলেন কিভাবে গাছ থেকে ঢেঁড়শ তুলতে হবে। উঠোনে খেলতে খেলতেই নাবিলার কানে আসে বিমানের ভারি শব্দ। বিমান দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাতেই নাবিলা দেখতে পায় একটা আগুনের গোলা ছুটে আসছে তাদের দিকে। প্রচণ্ড শব্দ। তারপর সব অন্ধকার। ধ্বংসস্তুপের মাঝে শুয়ে আছে নাবিলা ও তার ভাই, আর একটু দূরেই ছিন্নভিন্ন লাশ হয়ে আছে তাদের দাদী।

এই ঘটনার অনেকদিন পর ২০১৩ সালে নাবিলা ও তার স্কুল শিক্ষক বাবা ভাগ্যচক্রে তাদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ পান মার্কিন কংগ্রেসে। একটি বেসরকারি এনজিও’র সহায়তায় শেষমেষ তারা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। কিন্তু নির্ধারিত দিনের নির্ধারিত সময়ে কংগ্রেসে গিয়ে দেখতে পান তাদের অভিযোগ শোনার জন্য হাতে গোনা মাত্র পাঁচজন কংগ্রেসম্যান আছেন, অথচ সেখানে থাকার কথা ছিল ৪৩০ জনের। উপস্থিত পাঁচজনের মধ্যে কয়েকজন আবার ঝিমুতে ঝিমুতে নাবিলার বাবার অভিযোগ শুনছিলেন। সেদিন শিশু নাবিলা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাড়িয়ে দেশটির নীতি নির্ধারকদের একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন। যে প্রশ্নের উত্তর যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই বোধকরি দেয়া সম্ভব নয়। নাবিলা খুব সাবলীলভাবে কংগ্রেসম্যানদের জিজ্ঞেস করেছিল ‘কী দোষ করেছিল আমার দাদী যে তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হলো?’

শিশু নাবিলা আজও ওয়াজিরিস্তানে থাকে। আর দশটা শিশুর মতো তার স্বাভাবিক জীবন এখন আর নেই। কারণ মার্কিন ড্রোন বিমানের বোমা হামলার ধাক্কা তার মস্তিষ্ক ও শরীর এখনও নিতে পারেনি। এরকম দৃশ্য যে শুধু নাবিলার জীবনেই ঘটেছে তা নয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাকসহ অনেক দেশেই এই চিত্র আমরা দেখতে পাবো একটু খুঁজলেই। অথচ ঠিক এরকমই এক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন আরেক শিশু মালালা। পার্থক্য শুধু একটাই নাবিলাকে হামলা করেছিল মার্কিন ড্রোন আর মালালাকে হামলা করেছিল তালেবান বাহিনী। অথচ আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই তালেবানদেরই মদদ জুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের পর বিশ্ব রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিয়ে তালেবানদের প্রধান শত্রু বানিয়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের পূর্ব পর্যন্ত আল কায়েদার নাম বিশ্বের সাধারণ মানুষ জানতো না। সংগঠনটি ছিল পৃথিবীর আর দশটা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মতোই একটি।

আজ যখন শিশুদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ তালেবানদের হাতে হামলার শিকার হওয়ার কারণে মালালা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়, তখন মূলত পুরস্কারটা মালালা পায় না। পুরস্কারটা পায় সেই মার্কিনসৃষ্ট তালেবান গোষ্ঠি। কারণ তালেবান ও আল কায়েদাকে এরকম প্রচ্ছন্ন পুরস্কার দিয়ে জীবিত না রাখলে বুশ-ওবামার পক্ষে মার্কিন জনগণের সমর্থন আদায় করা সহজ হবে না। ২০০১ সাল পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার অনেক দেশেই এমন অনেকগুলো সংগঠনকে জোর করে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন বানানো হয় আদতে যারা একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল। এরও অবশ্য কারণ ছিল। মার্কিন সিনেটররা এবং দেশটির অস্ত্র ব্যবসায়ীরা মার্কিন জনগণকে একটা বিষয় বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে তাদের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে অন্যতম হুমকি আল কায়েদা। অবশ্য এই ভাবনা খুব সহজেই মার্কিন জনগণকে প্রলুব্ধ করতে পেরেছিল নাইন ইলেভেনের ঘটনার কারণে। আর তাই জাতীয় নিরাপত্তা ও খ্রিস্টধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদেরই প্রয়োজনে তৈরি করে ‘আলকায়েদা হেজিমনি’।

নোবলজয়ী মালালা তাই মার্কিন ‘আলকায়েদা হেজিমনি’কেই পুষ্ট ও পরিবর্ধন করে। অথবা বলা ভালো একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সবচেয়ে ছোটো এককের গুটি মাত্র মালালা। নাবিলা যেহেতু মার্কিন হামলায় আহত হয়েছিলেন তাই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে অভিযোগ জানানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্ববাসীকে যুক্তরাষ্ট্র এটাই প্রমাণ করতে চায় যে তারা কত মহান গণতন্ত্রী। শুধু তাই নয়, শান্তিতে নোবেল দেয়ার ক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয়েছে পাশাপাশি দুই দেশের দুই নাগরিককে। পাকিস্তান থেকে মালালা আর ভারত থেকে কৈলাস। এখানে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসতেই পারে, ঠিক কি কারণে এবারই একজন ভারতীয়কে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো।

এরও গূঢ় কারণ সেই আলকায়েদা। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম পশ্চিমা গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদে বলা হয়, আল কায়েদা ভারত নিয়ন্ত্রিক কাশ্মীরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায়। আমরা যদি কৈলাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো কৈলাস যে এনজিও মারফত শিশুদের অধিকার বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করেন সেই এনজিওটি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মুতেও কাজ করে। আর একথা তো আমরা সবাই জানি দক্ষিণ এশিয়ার প্রশ্নে কাশ্মীর ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরের সঙ্গে একদিকে যেমন আছে চীনের বাণিজ্য যোগাযোগ, তেমনি আছে বিশাল বন্দর সুবিধা। আলকায়েদাকে যদি কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে কাশ্মীরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ করতে কোনো বেগই পেতে হবে না। কারণ বিশ্ববাসীকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হলে একটা কাগজের ভিসার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো দেশে ঢুকতে হলে স্রেফ ‘আলকায়েদা ভিসা’ হলেই হয়। যেমনটা আমরা লিবিয়া, ইয়েমেন,ইরাক,সৌদিআরব,ইউক্রেন, সুদান, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়াসহ আরও অনেকগুলো দেশের ক্ষেত্রে দেখতে পাই।

তাই আসছে দিনে আরও কয়েকশত নাবিলা আহত বা নিহত হলেও পর্দার অন্তরালেই তারা ঢাকা পড়ে যাবে। বিশাল দৃশ্যপটে তাদের সামান্যতম জায়গাও হবে না। কারণ মার্কিন দৃশ্যপটে জায়গা পেতে হলে, হয় তাদের শত্রু হতে হবে নয়তো তাদের মিত্র হতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা যে হাজারও শত্রুতার সমান তা কমবেশি সবাই জানে। আর এই শত্রু-মিত্র খেলার মধ্যবর্তী সীমান্তে দাড়িয়ে নাবিলারা শুধু প্রশ্নই করে যাবে, ‘কি দোষ ছিল আমার দাদীর? কী দোষ করেছি আমি?’



মন্তব্য চালু নেই