ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পাননি এই মুসলিম নারী

ভারতের প্রচলিত ইতিহাসের কোথাও সে দেশের এক মুসলিম নারী সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজির নাম পাওয়া যায় না। ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে সর্বত্র যে নামটি পাওয়া যায় সেটি হলো পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। কিন্তু তিনি কী বাস্তবে ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার?

বর্তমান পতাকা
ভারতের জাতীয় পতাকা হল কেন্দ্রে চব্বিশটি দণ্ডযুক্ত নীল “অশোকচক্র” সহ গেরুয়া, সাদা ও সবুজ আনুভূমিক আয়তাকার ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই গণপরিষদের একটি অধিবেশনে এই পতাকার বর্তমান রূপটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে। এ পতাকার কেন্দ্রে রয়েছে অশোকচক্র, যা সম্রাট অশোক নির্মিত সিংহশীর্ষযুক্ত অশোকস্তম্ভ থেকে নেওয়া। সম্রাট অশোক হিন্দু-মুসলিম সবার নিকটই শ্রদ্ধেয় হওয়ায় এ অশোকচক্রও গৃহীত হয় সবার নিকট। কিন্তু কিভাবে পতাকায় এল এই চক্রটি? অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে এক মুসলমান নারীর নাম- সুরাইয়া।

ত্রিবর্ণ পতাকা
ভারতের পতাকার তিনটি বর্ণ। আর এ ত্রিবর্ণের পতাকা দুটি স্থানে উত্তোলনের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ছিল কলকাতায় এবং অন্যটি জার্মানিতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড এনসাইন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিরূপে সর্বাধিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল। ১৯৪৫-৪৭ সময়পর্বে জাতিসংঘে এই পতাকাটিই ভারতের পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হত। উভয় পতাকারই ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনার ছিলেন।

১৯০৬ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার পার্সিবাগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক সভায় প্রথম ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলিত হয়। অন্যদিকে ১৯০৭ সালের ২২ জুলাই জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ভিখাজি কামা অন্য একটি ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন।
ফলে ত্রিবর্ণ পতাকা কয়েকজনের ডিজাইনেই উঠে এসেছে কারো নির্দিষ্ট মস্তিষ্কপ্রসূত বলে ধরা যায় না।

পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার ডিজাইন
ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নাম পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। বলা হয়, তিনিই ভারতের জাতীয় পতাকাটির ডিজাইন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে কি তিনিই এ পতাকার ডিজাইনার?

১৯১৬ সালে অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনম শহরের নিকটস্থ ভাটলাপেনামারু গ্রামের বাসিন্দা পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া একটি সাধারণ জাতীয় পতাকার রূপদানের চেষ্টা করেন। মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছানুসারে একটি নতুন পতাকার নকশা করা হয়। এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার ওপরে ছিল সাদা, মধ্যে সবুজ ও নিচে নীল; যা যথাক্রমে সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়, মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতীক। তিনটি ডোরা জুড়ে খচিত ছিল চরকার ছবি। অবশ্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কখনই এটিকে সরকারি পতাকা হিসেবে গ্রহণ করেনি।

পতাকায় সংযোজনের জন্য নানামুখী দাবি
ভারতের পতাকায় নানা ধর্মীয় প্রতীক সংযোজনে আরও বহু ধর্ম ও গোত্র তাদের প্রতীক সংযোজনের দাবি করতে থাকে। এছাড়া পতাকার এই সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অনেকের মনেই অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ১৯২৪ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় সংস্কৃত কংগ্রেস হিন্দুধর্মের প্রতীক রূপে গেরুয়া রং ও বিষ্ণুর গদার চিত্র পতাকায় সংযোজনের প্রস্তাব দেয়। এই বছরই “হিন্দু যোগী ও সন্ন্যাসী এবং মুসলমান ফকির ও দরবেশদের মধ্যে প্রচলিত ত্যাগের প্রতীক” গেরু বা গিরিমাটি রং পতাকায় যোগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। শিখেরা দাবি তোলে, হয় তাদের প্রতিনিধিরূপে হলুদ রং পতাকায় রাখতে হবে, নয়তো পতাকা থেকে ধর্মীয় প্রতীকতত্ত্ব বাদ দিতে হবে।

গণপরিষদের সিদ্ধান্ত
ভারতের স্বাধীনতার কয়েকদিন আগে জাতীয় পতাকার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য গণপরিষদ স্থাপিত হয়। গণপরিষদ রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, কে এম মুন্সি ও বি আর আম্বেডকর। পতাকা কমিটি গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন। তিন সপ্তাহ পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাটি উপযুক্ত সংস্কারের পর সব দল ও সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণীয় করে তুলে জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হবে। পরে এমন প্রস্তাবও গৃহীত হয় যে ভারতের জাতীয় পতাকার কোনো সাম্প্রদায়িক গুরুত্ব থাকবে না। সে সময়েই চরকার পরিবর্তে সারনাথ স্তম্ভ থেকে অশোকচক্রটি গৃহীত হয় পতাকায়। ইতিহাসে প্রকাশ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারতে প্রথমবার এই পতাকাটি উত্তোলিত হয়। কিন্তু কোথা থেকে এল এই চক্রটি? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।

ইতিহাসের অন্ধকার দিক কিন্তু এ চক্রের আইডিয়াটি কার মাথা থেকে আসে এ বিষয়টি ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আর ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার নামই থেকে যায়। যদিও তিনি যে পতাকার ডিজাইন করেছিলেন, তার কেন্দ্রে ছিল একটি চরকা। তাহলে পতাকায় ব্যবহৃত চক্রটি সংযোজনের চিন্তাটি কার মাথা থেকে এসেছিল?

এ বিষয়ে ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ লিখেছেন, চরকা পছন্দ করা হয়েছিল কারণ এটি ধর্ম ও আইনের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে চরকার বদলে অশোকচক্রকে গ্রহণ করার ব্যাপারটি নেহরু স্বাগত জানান। তিনি পতাকায় চরকার বদলে ধর্মচক্র সংযোজনের বিষয়টিকে বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে করেন।

তবে গান্ধী বিষয়টি প্রথমে পছন্দ না করলেও পরে মেনে নেন। কিন্তু এ তো গেল অশোকচক্র সংযোজনের কথা। কিন্তু পতাকায় কে তুলে ধরলেন সে চক্র? এ বিষয়ে উত্তর মেলে এক ব্রিটিশ ইতিহাসবীদের লেখনিতে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লিখে গেছেন এক সুরাইয়ার কথা
সুরাইয়া তায়াবজির তৈরি করা ভারতের জাতীয় পতাকাটি প্রথম গৃহীত হয় ১৭ জুলাই ১৯৪৭ সালে।

ভারতীয় কোনো ইতিহাসবীদের লেখায় সুরাইয়ার তৈরি করা পতাকাটির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ইংলিশ ইতিহাসবিদ ট্রেভোর রয়েলের বইতে সুরাইয়ার নাম পাওয়া যায়। তার লেখা ‘দ্য লাস্ট ডেস অব দ্য রাজ’-এ জানা যায়, ভারতীয় জাতীয় পতাকাটির ডিজাইনার বদরুদ্দিন তায়াবজির স্ত্রী সুরাইয়া তায়াবজি।

ব্রিটিশ এ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘ভারতের ইতিহাসের মাঝে চলমান এ ধরনের বিতর্কের মাঝে আরেকটি হলো জাতীয় পতাকার ডিজাইন একজন মুসলমানের করা, বদর-উদ-দিন তায়াবজি। বাস্তবে তিন রঙের পতাকাতে ছিল একটি চরকা, যা গান্ধী তার পার্টির চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতেন। তায়াবজি মনে করেন এটি ভুল বিষয় উপস্থাপন করবে।

এরপর বহু চাপের পর গান্ধী এ চাকাটি পতাকায় নিতে রাজি হন। কারণ সম্রাট অশোক হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের নিকটই সম্মানিত ছিলেন। পতাকাটি নেহরুর গাড়িতে ওড়ে সেই রাতে, যা বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল তায়াবজির স্ত্রীর হাতে। ’ (সূত্র : Trevor Royle, The Last Days of the Raj, Cornet Books, Hodder and Stoughton, London)

ভারতীয় ইতিহাসে ওঠেনি সুরাইয়ার কথা
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ সুরাইয়ার কথা লিখে গেলেও তা ভারতীয় ইতিহাসে ওঠেনি। ভারতীয় বিভিন্ন দলিলপত্র ও পাঠ্য বইতে সর্বদা জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ার নামই পাওয়া যায়। তবে তার ডিজাইনকৃত পতাকাটির সঙ্গে সুরাইয়ার ডিজাইনকৃত পতাকার যথেষ্ট অমিল রয়েছে।

সুরাইয়া বদরুদ্দিন তায়াবজি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। জানা যায়, সুরাইয়ার স্বামী ছিলেন বদরুদ্দিন ফাইজ তায়াবজি। তিনি একজন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) অফিসার হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। সে সময়েই ভারতের জাতীয় পতাকার ডিজাইন করেন তার স্ত্রী। এরপর নেহরুর কাছে পতাকাটি নিয়ে গেলে তিনি তা পছন্দ করেন এবং তার গাড়িতে লাগিয়ে নেন। এরপর এ পতাকাটিই গৃহীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে। কিন্তু ডিজাইনার হিসেবে অজ্ঞাত কারণে কখনোই সুরাইয়ার নামটি তোলা হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই