বয়স ২৩, ধর্ষিত হয়েছি ৪৩,২০০ বার!
মেক্সিকোর নারী কারলা হাকিন্তো দরিদ্রের খপ্পর থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে পড়েছিলেন আরেক ভয়ানক খপ্পরে। মানুষ পাচারকারীরা অর্থের লোভ দেখিয়ে ছলেবলে তাকে আটক করে। তারপর একটানা ৪ বছর তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক যৌন নির্যাতন। প্রতিদিন ৩০ বার করে তার উপর এই নির্যাতন চালানো হতো। কেরালা হাকিন্তো শান্তভাবে সাংবাদিকদের জানিয়েছে, তিনি গুনে গুনে ৪৩ হাজার ২০০ বার ধর্ষিত হয়েছেন!
মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মানবপাচার বহুদিন থেকেই চলে আসছে কিন্তু কারলা হাকিন্তোর এই নির্মম কাহীনি যেন নতুন করে মানুষ পাচারের ভয়াবহ বাস্তবতা মনে করিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমান্তে এটা এখন এতই লাভজনক এবং প্রভাবশালী ব্যবসা যে সহজে এটাকে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ইউএস এবং মেক্সিকোর কর্তাব্যক্তিরা একমত হয়ে বলেছেন যে মেক্সিকোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি ছোট শহর তেনানচিং হচ্ছে এই ব্যবসার মূল কেন্দ্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাম্বাসেডর সুসান কপেজ জানিয়েছেন, যদিও শহরটির লোকসংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার। কিন্তু যৌন ব্যবসা এবং মানব পাচারে জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ওই শহরে এটাই মূল ব্যবসা কিন্তু কাজটা করা হয় নিপুনভাবে নিরবে। দালালেরা কৌশলে একটু গ্রামাঞ্চল থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে আসেন। গ্রামের মেয়েরা বুঝতেও পারে না যে তারা কত বড় ফাঁদে পা দিয়েছে।
কারলা হাকিন্তো ছিল ঠিক এইরকমই ফাঁদে পড়া এক মফস্বলের মেয়ে। তার ছোটবেলার জীবন ছিল খুব কষ্টের। পরিবারে সবসময় কলহ লেগে থাকতো এবং পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে মারধর করতো বাড়ির লোক। তার নিজের মা পর্যন্ত তাকে দেখতে পারতেন না। সেই শৈশব থেকেই আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই বিভিন্নভাবে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছেন বলেও অকপটে জানিয়েছেন তিনি। কারলা হাকিন্তো বড় হয়ে উঠেছে এইরকম করুন অবস্থার মধ্যে। তিনি তখনো জানতেন না তার জন্য আরো বড় দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করে আছে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে মানুষ পাচারকারীদের নজরে পড়ল কারলা হাকিন্তো। তার নিজের ভাষ্যমতে, তিনি একদিন মেক্সিকো শহরের একটি সাবওয়ে স্টেশনে তার বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক এমনসময় একটা বাচ্চা ছেলে মিষ্টি বিক্রি করতে করতে তার দিকে এগিয়ে আসে এবং তাকে একটা মিষ্টি দিয়ে বলে একজন কেউ তাকে মিষ্টিটা দিয়েছে উপহার হিসেবে।
তার পাঁচ মিনিট পরে এক লোক তার সাথে এসে কথা বলতে শুরু করে। লোকটা তাকে পরিচয় দেয় পুরনো গাড়ির ব্যবসায়ী বলে। প্রথম দিকে কথা বলতে কারলা একটু ইতস্তত বোধ করেছিল কিন্তু লোকটি যখন তাকে বলল যে সেও নাকি ছোটবেলায় কারলার মত এমন নির্যাতিত হয়েছিল তখন কারলা তার প্রতি সহানুভূতি বোধ করে। কারলা এমনকি তাকে তার ফোন নম্বর পর্যন্ত দিয়ে দেয়।
এক সপ্তাহ পরে যখন লোকটি তাকে ফোন করে একজায়গায় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনিসে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। লোকটি তাকে তুলে নিতে আসেন খুব দামি গাড়ি নিয়ে। এতে তিনি আরো অভিভুত হয়ে পড়েন। কী ভয়ানক বিপদে যে তিনি পড়তে যাচ্ছেন সেটা তার তখন তার কল্পনাতেও আসেনি।
নিজের বাড়িতে কারলা ছিল বহিরাগত একজন। তার মা সবসময় তার সাথে খারাপ ব্যবহার কররতন, এমনকি অনেক সময় তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে চাইতেন। এই অবস্থায় কারলাকে ঘর থেকে পালানোর জন্য রাজি করাতে একটুও বেগ পেতে হয়নি লোকটাকে।
একদিন ঠিকই সে লোকটার সাথে বেরিয়ে পড়লেন। লোকটা তাকে নিয়ে তুললেন এক বাড়িতে, সেখানে দুইজনের একসাথে কাটলো প্রায় তিন মাস। এই সময়ে লোকটা কখনোই তার সাথে খারাপ আচরণ করেননি। তাকে জামা, জুতো, কাপরচোপড় সব কিনে দিতেন। শুধু তাইনা, লোকটা তাকে মাঝে মাঝে ফুল কিনে দিতেন। অভিজ্ঞতাটা কারলা হাকিন্তোর জন্য ছিল আনন্দের। কিন্তু একইসাথে লোকটার অনেক সন্দেহজনক জিনিসও তার চোখে পড়েছে। যেমন লোকটা মাঝে মাঝেই তাকে ফেলে এক সপ্তাহের জন্য বাইরে চলে যেতেন। তখন বিভিন্ন মেয়েদেরকে নিয়ে তার ঘরে আসতেন লোকটার পরিচিত বন্ধুরা। এক পর্যায়ে কারলা যখন লোকটাকে সাহস করে ঘটনা জানতে চাইলেন তখন লোকটা তাকে তার আসল পরিচয় দিল। লোকটা হচ্ছে বেশ্যাদের দালাল। আস্তে আস্তে লোকটা কারালাকে খুলে বললেন, তাকে ঠিক কী করতে হবে। কিভাবে তাকে খদ্দেরদের সন্তুষ্ট করতে হবে, কত টাকা নিতে হবে, কতক্ষন সময় দিতে হবে ইত্যাদি সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল এইবার কারলার কাছে।
কারলার ভাষ্যমতে, এটা ছিল তার চার বছরের নরক যন্ত্রণার শুরুমাত্র। প্রথম কাজের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হল মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় শহর গুয়াদালাহারাতে। আমি সকাল দশটায় শুরু করতাম, শেষ করতাম মধ্যরাতে। প্রতিদিন ৩০ বার করে। এই অত্যাচারের একপর্যায়ে আমি কাঁদতে শুরু করতাম এবং এটা দেখে অনেক পুরুষই মজা পেয়ে হাসত। শেষদিকে আমার কোন অনুভূতি থাকতো না। এইভাবে চলতো দিনের পর দিন।
এইভাবে চার বছর কাটিয়েছে কারলা হাকিন্তো। তাকে এক শহরে বেশিদিন রাখতোনা দালালেরা। অনেকগুলো শহর ঘুরে ঘুরে তাকে দিয়ে জোর করে করানো হতো এই কাজ। এইসব কাজে অনেক ঝামেলা হতো অনেকসময়ই, কারালা কোনো ভুল করলে তখন তার উপর চড়াও হত দালাল। তাকে লোহার চেইন দিয়ে মারা হত আর কিল-ঘুষি-লাথির কথাতো এখানে মামুলি ব্যাপার।
এরপর একদিন ঘটলো এক চমকপ্রদ ঘটনা। কারলা এবং আরও অনেক মেয়েরা যখন একটা হোটেলে কাজ করছিল তখন সেখানে অতর্কিত হামলা করলো পুলিশ। কারলা ভেবেছিল এবার হয়তো সে মুক্তি পাবে কিন্তু তার কপাল বরাবরই খারাপ। পুলিশরা তাদেরকে মুক্তিতো দিলোই না বরং নিজেরাই তাদেরকে রুমে আটকে বিভিন্ন কুৎসিত ভঙ্গিতে তাদের ভিডিওচিত্র ধারণ করল। কারলার ভাষ্যমতে, সেখানে প্রায় ৩০ জন পুলিশ ছিল এবং তারা তাদেরকে দিয়ে কাজ হাসিলের জন্য অনেক হুমকি ধামকি দিয়েছে।
এই চার বছরে বিপদের উপর বিপদ তাড়া করে বেড়িয়েছে কারলাকে, কারণ এরমধ্যে সে আবার গর্ভবতীও হয়ে পড়েছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সে একটা কন্যা সন্তান প্রসব করে। সেই সন্তানের বাবা ছিল এক দালাল। কিন্তু জন্মের পরপরই তাকে কেড়ে নেয়া হয় কারালার কাছ থেকে, কারণ মেয়ে সাথে থাকলে ব্যবসা বন্ধ। মেয়ের বয়স এক বৎসর হওয়ার আগ পর্যন্ত কারলা তার মেয়েকে দেখতে পায়নি।
অবশেষে ২০০৬ সালে মেক্সিকোতে মানুষ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এক অভিযান চলাকালে মুক্তি পায় কারলা হাকিন্তো। তার বয়স এখন ২৩ বছর। আর দশটা সাধারণ মেক্সিকান নির্যাতিত মেয়েদের মত জীবন কাঁটিয়েও কারলা হাকিন্তো থেকে যেতে পারতো মানুষের অগোচরে। কিন্তু না, জীবন থেকে সে যে কষ্ট পেয়েছে সেটা যাতে আর কোন নারী না পায় তার জন্য মুখ খুলেছে কারলা হাকিন্তো। তার কণ্ঠ এখন মানুষ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার। সে সারা বিশ্বের মানুষকে বলতে চায় কি নির্মম জীবন তাকে যাপন করতে হয়েছে কিছু নিষ্ঠুর মানুষের পাল্লায় পড়ে। কারলা হাকিন্তো তার এই নির্যাতিত গল্পের কথা বলতে একটুও ভয় পায় না, একটুও লজ্জাও পায় না।
মন্তব্য চালু নেই