বিশ্বনেতাদের হত্যা ষড়যন্ত্রে সিআইএ’র দীর্ঘ ইতিহাস

নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ দেশটির। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবু নানা দেশে বিরোধীমতাবলম্বী নেতাদের গুপ্তহত্যা-উচ্ছেদের মার্কিন ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন বার্তাই দেয়।

ভিন্নমতাবলম্বী-রাশিয়া ঘনিষ্ঠ এমন অভিযোগে বেশ কয়েকজন নেতাকে উচ্ছেদের ইতিহাস বা হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিউবার সাবেক নেতা প্রয়াত ফিদেল কাস্ত্রো। যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যা ষড়যন্ত্র বারবার নস্যাৎ করে দেওয়া এই মহান নেতা একবার বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, “গুপ্তহত্যা থেকে বাঁচার কোন প্রতিযোগিতা অলিম্পিকে থাকলে, আমি স্বর্ণ পদক জিততাম।”

নর্থ কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দফতর এক বিবৃতিতে গত শুক্রবার জানায়, সিআইএ তার পুরোনো এই (গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র) পন্থা ত্যাগ করেনি। নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে হাত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সাউথ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার।

বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত একজন নর্থ কোরিয়ান এই হত্যার প্রচেষ্টায় সরাসরি জড়িত বলেও জানায় দেশটি। প্রেসিডেন্টকে হত্যায় ব্যবহার করা হতো একধরণের জৈবরাসায়নিক পদার্থ, যাতে তেজষ্ক্রিয় ও বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। এই বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশের পর ছয় থেকে বারো মাস পরে কাজ করে।

নর্থ কোরিয়ার এই দাবি অস্বীকার করে সিআইএ’র একজন মুখপাত্র।

অভিযোগটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, কারণ বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতাকে হত্যা এবং উচ্ছেদে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) তৎপরতা অনেকটা সর্বজনবিদিতই বলা যায়।

যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে। যিনি ৯০ বছর বয়সে গতবছর মৃত্যুবরণ করেন। কিউবার সমাজতান্ত্রিক এই নেতাকে হত্যার প্রচেষ্টাগুলোও ছিলো বেশ অভিনব, গোয়েন্দা চলচ্চিত্রগুলোকেও যেনো তা হার মানিয়ে দেয়। এর মধ্যে ছিলো ক্যাস্ত্রোর প্রিয় চুরুটে বিস্ফোরক গুজে দেওয়া, স্কুবা ডাইভিং স্যুটে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার মতো চমৎকৃত পন্থা। খোদ যুক্তরাষ্ট্রই তাকে ৮ বার হত্যা চেষ্টার কথা স্বীকার করে, তবে কিউবার দাবি তা শত শত।

বহু বিদ্রোহের পর ১৯৫৯ সালে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ! এমন দাবি কাস্ত্রোর ৪৯ বছরের শাসনামলের পুরো সময় তার নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফেবিয়ান এসকালান্তের। কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা বেশির ভাগই হয় ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যানেল ফোর কাস্ত্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে ‘৬৩৮ ওয়েজ টু কিল কাস্ত্রো’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে, যা ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার করা হয়।

কাস্ত্রোর ক্ষেত্রে বিফল হলেও ১৯৪৫ সাল থেকে বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতাদের হত্যায় ও উচ্ছেদে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সফল হয়। কখনোও এই তৎপরতা সরাসরি আবার অধিকাংশ সময়ই তা পরিচালিত হয় স্থানীয় সেনা, স্থানীয় ভাড়াটে অপরাধী বা বিদ্রোহীদের দ্বারা। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে সিনেটের পরিচালিত এক তদন্তের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই কার্যক্রম অনেকটাই হ্রাস করে। তদন্তে সিআইএ’র অভিযানের মাত্রা প্রকাশ করা হয়।

এই তদন্তের পর তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। যেখানে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোন কর্মচারী রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, বা এর ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হবে না।”

এই নির্বাহী আদেশের ফলে সিআইএর কর্মকাণ্ড অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা সংস্থাটির জন্য নিঃসন্দেহে ছিলো অস্বস্তিদায়ক। এছাড়াও তা কেন্দ্রীয় সরকারের একধরণের স্বীকারোক্তি যে, যুক্তরাষ্ট্র অনুপ্রাণীত অভ্যুত্থান বা গুপ্তহত্যা অনেক সময় ভিন্ন ফল দেয়।

তবুও যুক্তরাষ্ট্র কখনোও এই নীতি থেকে সরে আসেনি। শুধু তাদের এই তৎপরতার নামকরণ ‘গুপ্তহত্যা’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ‘পরিকল্পিত হত্যা’। তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিলো অভিযুক্ত ‘সন্ত্রাসী’ নেতাদের উপর বোমা হামলা বা ড্রোন হামলা চালানো। ১৯৮৬ সালে মার্কিন বিমান হামলার শিকার হয়েছিলেন লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ১৯৯৯ এ সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিক এবং ২০০৩ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেইন।

এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের এমন তৎপরতার যেসকল ইতিহাস বেশ তথ্যসমৃদ্ধ তার মধ্যে রয়েছে কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক লুমুম্বা। যাকে রাশিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬০ সালে সিআইএ তাকে হত্যার জন্য প্রাণঘাতী ভাইরাসসহ একজন বিজ্ঞানীকে পাঠায়, যদিও তা ছিলো নিষ্প্রয়োজন। কেননা ১৯৬০ সালেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।

এছাড়াও ১৯৬০ এর দশকে মার্কিন গুপ্তহত্যার টার্গেট হন ডোমিনিকান রিপাবলিকের শাসক রাফায়েল তুজিলো (১৯৬১ সালের মে মাসে গুপ্তহত্যার শিকার), ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্নো (১৯৬৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত ও ১৯৭০ সালের জুনে মৃত্যুর আগপর্যন্ত গৃহবন্দী) এবং সাউথ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট নগো দিন দিয়েম (১৯৬৩ সালের নভেম্বরে গুপ্তহত্যার শিকার)।

১৯৭৩ সালে সিআইএ চিলির বামপন্থী প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দেকে উৎখাত প্রচেষ্টা সংগঠনে সহযোগিতা করেছিলা, অভ্যুত্থানের দিনই নিহত হন আলেন্দে।

নর্থ কোরিয়ান প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র অনেকটাই স্থুল মনে হতে পারে কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ এখন এমনই। নর্থ কোরিয়ান এই ষড়যন্ত্র ২০০৬ সালে রাশিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকো-কে গুপ্তহত্যার কথাই মনে করিয়ে দেয়। একটি ব্রিটিশ তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসে, তাকে হত্যা করেছিলো রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা। চা পাত্রে পোলোনিয়াম (অতিশয় তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থবিশেষ) লুকিয়ে রেখে তাকে হত্যা করা হয়।

চা পাত্রে পোলোনিয়াম রাখার চেয়ে আরও অনেক অত্যাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত এই ইলেকট্রনিক ও সাইবার যুগে। এই বছরের শুরুতে উইকিলিকসের ফাঁস করা এক নথিতে দেখা যায়, ২০১৪ সালের অক্টোবরে সিআইএ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হ্যাক করার চেষ্টা করেছিলো। এই ক্ষেত্রে সফল হলে তারা অনায়াসেই গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারবে।

সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে মূল প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রেও তাদের কম্পিউটার সিস্টেমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান)



মন্তব্য চালু নেই