বিশেষ আনসার : প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আশায় ১৭ বছর পার

খুলনার তেরখাদা এলাকার কামরুল ইসলাম। এক সময় ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী দলের সদস্য। পলাতক আর সন্ত্রাসী জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু পথ পাচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হচ্ছিল না। এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসলো যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তখন আরও অনেকের মতো আমিও আত্মসমর্পণ করি। এরপর আনসার বাহিনীতে মাস্টার রোলে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ পাই। প্রতিশ্রুতি ছিলো, পরবর্তীতে আত্মীকরণের মাধ্যমে আমাদের ব্যাটালিয়ন আনসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে চাকরি স্থায়ী করা হবে। এরপর ১৭ বছর পার হয়েছে। কিন্তু চাকরি স্থায়ী হয়নি।’খবর বাংলা ট্রিবিউনের।

কামরুলের মতো এমন সাড়ে ৪০০ বিশেষ আনসার আছেন যারা চাকরি স্থায়ী হবে এই আশায় ১৭ বছর পার করেছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় লাল ফিতায় বন্দি সরকার প্রধানের চাকরি স্থায়ীকরণের দেওয়া প্রতিশ্রুতি। ফলে বিশেষ আনসার সদস্যরা পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাচ্ছেন অনিশ্চিত জীবন। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণ চান দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বিশেষ আনসার সদস্যরা।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত বিশেষ আনসার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘১৭ বছর বিশেষ আনসার হিসেবে চাকরি করছি। বর্তমানে বেতন পাই সাড়ে আট হাজার টাকার মতো। নতুন বেতন স্কেলে এক হাজার ৩৫০ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। আনসারের অন্য সদস্যরা আগামী মাস থেকে এ টাকা ঠিকই পাবেন। কিন্তু পাবো না কেবল আমরা।’

তিনি বলেন, মেয়েটা সপ্তম শ্রেণিতে ও ছেলেটা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন চট্টগ্রামেই। পুলিশ লাইনে কর্মরত থাকার কারণে সেখানকার কর্মকর্তারা প্রায়ই সাহায্য-সহযোগিতা করেন বলেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন।

জয়পুরহাট পুলিশ লাইনে কাজ করেন বিশেষ আনসার সদস্য প্রশান্ত মল্লিক। বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। তার কাহিনীও প্রায় একই। তিনি বলেন, স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তারা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। দুই মেয়ে স্নাতক পাশ করেছে। অর্থাভাবে আর পড়ালেখা করাতে পারেননি। স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করেন।

প্রশান্ত মল্লিক বলেন, ‘এক কথায় বললে বলবো খুবই কষ্টে আছি। মাস্টার রোলে আট হাজার ৮৬০ টাকা বেতন পাই।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ লাইনে থাকার কারণে খাবারসহ কয়েকটি খাতে প্রতি মাসে এক হাজার ৯৮৫ টাকা কেটে নেওয়া হয়। এরপর নিজের হাত খরচ। চাকরিটা স্থায়ী হবে সেই আশায় ১৭ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এখন তো আর চাষাবাদ করতে পারবো না। সেজন্যই এ অপেক্ষা। মৃত্যুর আগে সেই অপেক্ষা শেষ হবে কিনা জানি না।’

একই কথা বলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় কর্মরত বিশেষ আনসার সদস্য আবদুল আলিম। তিনি বলেন, ব্যাটালিয়ন আনসারদের মতো শতভাগ রেশন, নিয়মিত বেতন ও চাকরি স্থায়ী করতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি গত ১৭টি বছর। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের বিষয়টি মানবিক বলে উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তাতেও কোনও উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আনসার বাহিনীর সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ‘৯০ দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থীদের উৎপাত চরম আকার ধারণ করে। ১৯৯৯ সালে পুলিশ ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু বিশেষ অভিযানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পদক্ষেপ স্বত্ত্বেও তাদের দমন করা যাচ্ছিল না। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, চরমপন্থীদের দলের যারা আত্মসমর্পণ করবেন তারা সাধারণ ক্ষমার সুযোগ পাবে এবং তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তখন চরমপন্থী বিভিন্ন গ্রুপের দুই হাজার ১২৬ সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। যাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা ছিল না তাদের মধ্য থেকে ৭৬৫ জনকে আনসার বাহিনীতে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসনের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে বেশ কিছু সদস্যকে চাকুরিচ্যুত করা হয় এবং কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে ৪৫০ জন বিশেষ আনসার সদস্য দেশের ৩৫টি জেলায় পুলিশের সঙ্গে কর্মরত রয়েছেন।

গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের আনসার একাডেমিতে আনসার সদস্যদের এক দরবারে বিশেষ আনসার ও হিল আনসারদের স্থায়ীকরণের বিষয়টি মানবিক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী তখন সংশ্লিষ্টদের জানান। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

বিশেষ আনসারের চাকরি স্থায়ীকরণসহ আনসার সদস্যদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনাগুলোর হালনাগাদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই পর্যালোচনা সভা অনিবার্য কারণে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আনসার ও সীমান্ত) কমল কান্তি বৈদ্য।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনাসমূহের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এ মুহুর্তে তার জানা নেই। ফাইল দেখে বলতে হবে।’



মন্তব্য চালু নেই