বিলুপ্তির পথে সেই নিপুন শিল্পের স্থপতি বাবুই পাখির বাসা
‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে। বাবুই হাসিয়া বলে সন্দেহ কি তায়, কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়।’
মানুষের মানবিক বোধ জাগ্রত করার জন্য কবি রজনী কান্ত সেনের কালজয়ী কবিতাটি এক সময় ছিল মানুষের মুখে মুখে। এটি এখন শুধু আমাদের পাঠ্য পুস্তকেই অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটির মর্ম এখন আর আমাদের মনে সাড়া জাগায় না।
কালের বিবর্তন আর শহুরে যান্ত্রিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি আর তার নিপুন শিল্পকর্ম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তন আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে ও ঘন বসতি স্থাপনে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ায় বিপন্ন আবহমানকালের ঐতিহ্য এই পক্ষী প্রজাতি।
বাবুই পাখির বাসা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ো বাতাসেও টিকে থাকে তাদের বাসা। শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া বেশ কঠিন। বাবুই পাখি একাধারে শিল্পি, স্থপতি এবং সমাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি।
একসময় পটুয়াখালীর উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলে সারি সারি উঁচু তালগাছে ঝুলে থাকতে দেখা যেত দৃষ্টিনন্দন চমৎকার আকৃতির বাবুই পাখির বাসা। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচি পাতা, ঝাউ ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে তৈরি এ বাসায় রয়েছে নিপুন শিল্পকর্মের ছোঁয়া। তাই এখন এ নিপুন শিল্পকর্মটি শোভা পায় অভিজাত মানুষদের ড্রইংরুমে।
বাবুই পাখিরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য পুরুষ বাবুই নিজের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য খাল বিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফুর্তিতে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। এর পর উঁচু তালগাছ, নারিকেল বা সুপারি গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। অর্ধেক কাজ শেষ হলে কাঙ্খিত স্ত্রী বাবুইকে ডেকে সেই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলেই কেবল পুরো কাজ শেষ করে। বাসা পছন্দ না হলে অর্ধেক কাজ করেই নতুন করে আরেকটি বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। অর্ধেক বাসা তৈরি করতে সময় লাগে পাঁচ-ছয় দিন স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে লাগে আরও চার দিন। কেননা তখন পুরুষ বাবুই মহানন্দে বিরামহীনভাবে কাজ করে। স্ত্রী বাবুইর প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই নিপুনভাবে বাসা তৈরি করে।
স্ত্রী বাবুই ডিম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষ বাবুই খুঁজতে থাকে নতুন সঙ্গীকে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা বাসা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম হলো ধান ঘরে ওঠার মৌসুম। স্ত্রী বাবুই দুধ ধান সংগ্রহ করে এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়।
বাবুই পাখি তালগাছে বাসা বাঁধে বেশি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী গ্রামগঞ্জের তালগাছগুলো কেটে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করায় দিনদিন কমে যাচ্ছে তালগাছের সংখ্যা হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি আর তার সাথে হারাচ্ছে তাদের শিল্পকর্ম।
পরিবেশবাদীদের মতে, জ্বালানি হিসেবে তালগাছের ব্যাবহার বন্ধ করা দরকার, সেইসাথে দরকার আনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধ করা। এসব ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে বেশিরভাগ সময়েই তাল জাতীয় গাছ ব্যাবহার করা হয়। ফলে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
মন্তব্য চালু নেই