ভূমিকম্প আতংক

বিপজ্জনক অবস্থায় বরিশাল

দেড়’শ বছরের পুরানো নগরীর কাউনিয়া প্রধান সড়কের জমিদার মোহন ব্যানার্জীর বাড়ির ভবন। ওই ভবনে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চল্লিশ বছর ধরে বসবাস করছে দুটি পরিবার। একই অবস্থা বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের হাবিবুর রহমান ছাত্রাবাস, বিএম কলেজের সুরেন্দ্র ভবন ছাত্রাবাস, বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রী হোষ্টেল ও সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের শহীদ আলমগীর ছাত্রাবাস। এভাবেই নগরীর ৩৪টি বহুতল ভবনকে গত দু’বছর পূর্বে নামেমাত্র অধিক ঝুঁকিপুর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো সিটি কর্পোরেশন। অদ্যবর্ধি ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙ্গে ফেলার ব্যাপারে আর কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও দশকের পর দশক ধরে মৃত্যুকে সঙ্গী করেই এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস, অফিসিয়াল ও ব্যবসায়ীক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন সহস্রাধীক মানুষ।

সূত্রমতে, দেশে গত কয়েকদিনের তিন দফা ভূমিকম্পের পর আতংক দেখা দিয়েছে ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাসকারীদের। দ্বিতীয় দফার ভূমিকম্পে বিএম কলেজের বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রী হোষ্টেল ভবন, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের হাবিবুর রহমান ছাত্রাবাসসহ একাধিক ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। যেকোন সময় এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ধ্বসে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা করছেন নগরবাসী। সূত্রে আরো জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের নকশা অনুযায়ী নির্মিত নগরীর হাতেম আলী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় জাহাঙ্গীর হোসেনের মালিকানাধীন ‘শেখ নিবাস’ নামের পঞ্চম তলার একটি ভবন ২০১৩ সালের ৫ মে বিকেলে পাশ্ববর্তী ষষ্টতলা ভবনের ওপর হেলে পরে। ওইসময় সিটি কর্পোরেশন, প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে ভবন মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মালামাল সরিয়ে নেয়ার পর তাৎক্ষনিক ভবনটি সীলগালা করে দিয়েছিলেন বিসিসির ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ ইসরাইল হোসেন। বর্তমানে ওই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি অফিস ও বাসা হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

নগরীর সুশীল সমাজের একাধিক নেতৃবৃন্দরা জানান, দীর্ঘদিন পূর্বে বিসিসি কর্তৃপক্ষ সরকারী ও ব্যাক্তি মালিকানাধীন মিলিয়ে মাত্র ১০টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এরইমধ্যে সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধ্বসে ভয়াবহ দুর্ঘনার পর টনক নড়ে বিসিসি কর্তৃপক্ষের। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল বিসিসির একটি টিম পূর্ণরায় নগরীতে ঝুকিপুর্ন ভবন চিহ্নিতকরনের কাজ শুরু করেন। এতে পূর্বের ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসহ বেরিয়ে আসে আরো ২৩টি ভবন। সর্বশেষ নগরীর হাতেম আলী কলেজ সংলগ্ন এলাকার ‘শেখ নিবাস’ নামের হেলে পড়া পঞ্চম তলা ভবনটিকেও ঝুকিপুর্নতার তালিকায় আনা হয়। নামেমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তালিকা করা হলেও রহস্যজনক কারনে দীর্ঘদিনেও আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বিসিসি কর্তৃপক্ষ। অতিসম্প্রতি তিন দফার ভূমিকম্পের পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে নগরবাসীর মাঝে ফের আতংক ছড়িয়ে পরে। ঝুঁকিপুর্ন কয়েকটি ভবন ঘুরে দেখা গেছে, এখনও কয়েকশত মানুষ ওইসব ভবনে বসবাস করছেন। ভবনগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, শত বছরের পুরানো ভবন জেনেও অন্যকোন স্থান না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই তারা বসবাস করছেন।

সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো হচ্ছে, কাউনিয়ার জানুকিসিং রোড এলাকার লস্কার ভবন, কাউনিয়া প্রধান সড়কের সিরাজ মহল, বেনী লাল মহল, পূর্ব বগুড়া রোডের রবিন্দ্র নাথ ভবন, আগরপুর রোডের মহিলা কলেজের দক্ষিন পার্শ্বের মনু ভবন, ফজলুল হক এভিনিউ রোডের বাহাদুর ভবন ও গোল্ডেন টাওয়ার, সার্কুলার রোডের মুনসুর ভবন, ঈশ্বর বসু রোডের সৈয়দ মঞ্জিল, অমৃত লাল দে কলেজের দক্ষিন পার্শ্বের মৃধা ভবন, কালু শাহ সড়কের জালাল ভবন, মেজর এম.জলিল সড়কের হাতেম আলী কলেজের সৈয়দ আলমগীর হোসেন ছাত্রাবাস ও কলেজের জ্ঞান বিজ্ঞান ভবন, সদর রোডের ফরিদ উদ্দিনের ক্ষণিকা মেডিকেল লেন, সরকারী বিএম কলেজের সুরেন্দ্র ভবন ও বনমালী গাঙ্গুলী ছাত্রীনিবাস, বগুড়া রোডের সালমা ভবন, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন সড়কের পশ্চিম পার্শ্বের হাজী ভবন, নগর ভবনের পেছনের পরিত্যক্ত হাজতখানা, শেবাচিম হাসপাতালের সামনের ক্ষণিকা ভবন, কলেজ রোড এলাকার ফরিদ ভবন, উপজেলা পরিষদ বরিশাল সদর ভবন, সদর রোডের সৈয়দ ভবন, রুপাতলীর নলছিটি প্লাজা, কাটপট্টির মিল্লাত ফার্মেসী, চন্দ্রিমা ব্রাদার্স, আহম্মদ ক্লথ ষ্টোর্স, বেলায়েত ষ্টোর্স, জুম্মান ব্রাদার্স, অমৃত ভবন, সৈয়দ ষ্টোর্স, চিত্ত ভবন, সাধনা ঔষধালয় ও হাতেম আলী কলেজ সংলগ্ন এলাকার ‘শেখ নিবাস’ নামের হেলে পড়া পঞ্চম তলা ভবন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত বিভাগের এক প্রকৌশলী জানান, শুধু নগরী নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থানা কম্পাউন্ডের কোয়ার্টার এবং হাসপাতাল ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ব্যবহারে সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পরেছে। তিনি আরো জানান, শুধু ভূমিকম্পনই নয়; যেকোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওইসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ধ্বসে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে।

এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খান মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, ভবন নির্মানের সময় সঠিক প্লান, উপযুক্ত মালামালের ব্যবহার ও তদারকির জন্য দক্ষ প্রকৌশলী নিয়োগ না করায় ভবনগুলো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছেনা। তাই নির্মাণের শুরুতেই এ বিষয়গুলো দেখভাল করলে ভবন স্থায়ী হবে।

নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আহসান হাবিব কামাল জানান, তারা ঝুকিপুর্ন ৩৪টি ভবনের মালিকদের প্রাথমিকভাবে চিঠি দিয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে মালিক পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙ্গে ফেলার ব্যাপারে নগরবাসীকে সাথে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



মন্তব্য চালু নেই