বিকাশ অ্যাকাউন্ট অনিরাপদ, অরক্ষিত গ্রাহকের ৮০০ কোটি টাকা
মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনে বিকাশই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যাদের গ্রাহক অ্যাকাউন্টের (হিসাব) সঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। অবশ্য বিকাশকে যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়েছে তাতে তার দরকারও নেই। এ কারণে প্রতি মুহূর্তে বিকাশের কাছে ১ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের যে ৮০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি (সঞ্চিতি) আমানত থাকে তার কোনো সুরক্ষা দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০ বা প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন, ২০১৪ এর আওতায় বিকাশ আমানত গ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ করে না। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিকাশের ‘ডিপোজিট ইন্সুরেন্স সিস্টেমে’ অন্তর্ভূক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিকাশের আমানতে সুরক্ষা না দেয়ার। তাই অরক্ষিতই থেকে যাচ্ছে বিকাশে গ্রাহকের ৮০০ কোটি টাকা।
জানা যায়, বিকাশ গ্রাহকরা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে যখন এজেন্টের কাছে ক্যাশ আউট বা ক্যাশ ইন করে তখন সেটার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয় ই-মানিতে। ই-মানি ট্রান্সফার হয় বিকাশ অ্যাকাউন্টে, আর দু’পক্ষের হাতে হাতে লেনদেন হয় নগদ টাকা। গ্রাহক ও এজেন্টের মধ্যকার লেনদেনে যে সময় অর্থাৎ গ্রাহক তার ই-মানি এজেন্টের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক নগদায়ন করতে ব্যর্থ (টাকাটা বিকাশ অ্যাকাউন্টে থেকে যায়) হয় বা কিংবা গ্রহণ করে না- এই অর্থই বিকাশের কাছে গ্রাহকের আমানত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রতি মুহূর্তে এই আমানতের ন্যূনতম স্থিতি থাকে ৮০০ কোটি টাকা বা তারও উপরে। যে অর্থটি বিকাশ ব্র্যাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা রাখে।
মোবাইল ব্যাংকিং-এ কার্যরত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যাংক লেট মডেলে কার্যরত ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং, এম ক্যাশ, মোবি ক্যাশসহ সর্বমোট ২০টি প্রতিষ্ঠানের লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিকাশের কার্যক্রমের একটা ফারাক রয়েছে। বিকাশ ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠানগুলোর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এ হিসাব খোলা হলে গ্রাহকের একই কেওয়াইসির (গ্রাহক পরিচিতি তথ্য) তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেও একটি হিসাব খোলা হয়। অর্থাৎ এদের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হলে বা টাকা জমা থাকলে উল্লিখিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। যা সরাসরি ব্যাংকে টাকা রাখার মতোই। কিন্তু বিকাশ একমাত্র প্রতিষ্ঠান যাদের প্রতিটি গ্রাহকের আলাদা আলাদ কোনো অ্যাকাউন্ট (হিসাব) ব্র্যাক ব্যাংকে নেই। যে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা শুধু বিকাশেই সংরক্ষিত। বিকাশ তার নির্ধারিত অ্যাকাউন্ট দিয়ে সব গ্রাহকের টাকা ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করে।
ব্যাংক লেট মডেল অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের উক্ত অপরিশোধিত (জমা থাকা ই-মানি) অর্থ ক্লাস্টার (গুচ্ছ) অ্যাকাউন্ট হিসেবে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অথবা ভিন্ন একটি নামে গ্রাহক আমানতের অন্তর্ভূক্ত করে বীমা নির্ধারণীতে দাখিল করে। প্রতিটি গ্রাহকের আলাদা আলাদা পরিচিতিমূলক তথ্য ব্যাংকের হিসাবের খাতায় অন্তর্ভূক্ত থাকে। যার ফলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৩ ধারা অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় পরিচালিত গ্রাহকের আমানত এককভাবে বিদ্যমান ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০ কিংবা প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন ২০১৪ এর আওতায় সুরক্ষিত। আর এই প্রক্রিয়াটি বিকাশের কার্যক্রমে নেই বলেই তাদের আমানতকে সুরক্ষা দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তথ্য মতে, বাংলাদেশে আমানত গ্রহণকারী অনেক প্রতিষ্ঠান- যেমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কো-অপারেটিভ ব্যাংক, মাইক্রো ক্রেডিট, ইন্সুরেন্স কোম্পানি আছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল আর্থিক কোম্পানিগুলোকে আমানত গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কোনো আইন বা বিধান নেই। বিকাশ কিংবা অনুরূপ কোনো সাব-সিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান গ্রহকদের আমানতকে প্রস্তাবিত আমানত সুরক্ষা আইন, ২০১৪ তে সন্নিবেশ করতে হলে উপরোক্ত আমানত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আমানত বীমা সিস্টেমে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। আর বিকাশকে আমানত বীমার আওতায় আনতে হলে আরো ৩ ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। সেজন্য প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপক পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হবে।
জানা যায়, গভর্নরের মতামত নিয়েই এই মুহূর্তে শুধু বিকাশের জন্য আইনের এমন পরিবর্তন ও সংশোধন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই বিকাশে গ্রাহকের আমানতে সুরক্ষা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য সকল ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের নীতিমালার আলোকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক ব্রাঞ্চ বা ইউনিট গঠন করে। যার আওতায় তাদের গ্রাহকের নামে পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে গ্রাহক সেবা প্রদান করে। তবে ব্র্যাক ব্যাংকের সাব-সিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান বিকাশের জন্যও একই ধরনের নীতিমালা থাকলেও তাদেরকে ‘বিশেষভাবে একটু’ ছাড় দিয়েই অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বিকাশের বিষয়ে যে কোন ধরনের নির্দেশনা দিয়ে চিঠিপত্র আমরা ব্র্যাক ব্যাংকের কাছেই পাঠাই। বিকাশের কোনো কিছু হলে আমরা তার জবাবদিহিতা ব্যাংকটির কাছ থেকেই নেবো। মূল চুক্তিটা আমাদের ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গেই।’
বিকাশ বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট দিয়ে রিচার্জ, কেনাকাটা করার মতো বিভিন্ন অফার দিয়ে থাকে। এটা করছে তারা আমানত বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে আমানতে কোনো প্রকার সুরক্ষাই নেই সেখানে গ্রাহক কেন অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবে?
বিকাশের মুখপাত্র জাহেদুল ইসলাম এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি। তবে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা রাখলে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ হারে গ্রাহককে আমানতের উপর সুদ প্রদান করা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই