বাবা না থাকলে সন্তানের নাগরিক স্বীকৃতি নয়
নেপালের নাগরিক দিপ্তি গুরুংয়ের বয়স ৪০। দুই মেয়ে যখন ছোট তখন স্বামী তাকে ফেলে চলে যান। কিশোরী দুই মেয়ের নাগরিক সনদের জন্য কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু মেলেনি। কারণ, সরকারি কর্মকর্তারা স্বামী ছাড়া বসবাস করছেন এমন নারীদের সন্তানদের নাগরিক সনদ দিতে ইচ্ছুক নয়। আর শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি বিলও পাস হতে যাচ্ছে দেশটির সংসদে। এটি পাস হলে স্বামীবিহীন কোনো মায়ের পক্ষে তার সন্তানদের নাগরিক সনদের জন্য আবেদন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নিজ দেশে পরবাসী হবেন তারা।
সন্তানদের জন্য নাগরিক সনদের আবেদন করলে নারীদের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে হয়রানির শিকার হতে হয় জানিয়ে দিপ্তি বলেন, ‘তারা নারীদের জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হয়রানি করে, সন্তানদের বাবার পরিচয়পত্র চায়। কিন্তু যখন কোনো বাবা তার সন্তানের সনদের জন্য আবেদন করেন তখন তাকে কোনো প্রশ্নই করা হয় না।’
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আগামী বছর নেপালের সংসদে পাস হতে যাচ্ছে নতুন সংবিধান। এই সংবিধানের মধ্যে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা ও নিয়ম-কানুন অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া বিলে বলা হয়েছে, কোনো শিশুর নাগরিক স্বীকৃতির জন্য তার বাবা-মা উভয়কেই নেপালের নাগরিক হতে হবে। অথচ ২০০৬ সালের একটি আইনে বলা হয়েছে, যে শিশুর বাবা-মার মধ্যে একজন নেপালের নাগরিক, তাকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে- প্রস্তাবিত এই খসড়াটি আগের আইনের পুরো বিপরীত।
সরকারের এই বিমাতাসুলভ আচরণ ও সংসদে উত্থাপিত হতে যাওয়া বিলটির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছে। তারা বলছে, বিলটি পাস হলে দশ লাখেরও বেশি লোক রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। আর এর সবচেয়ে বেশি শিকার হবে নারীরা। কারণ নেপালে স্বামী ছাড়া বসবাস করছেন এমন মায়েদের সংখ্যা অনেক বেশি।
নারীদের উন্নয়ন ও আইন রক্ষা বিষয়ক ফোরাম দ্য ফোরাম ফর ওমেন ল অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এফডব্লিউএলডি) নামের একটি সংগঠনের মতে, আইনটি পাস হলে দশ লাখ শিশুর ওপর এর প্রভাব পড়বে। কারণ, এসব শিশুর ৯০ শতাংশ মা-ই স্বামীহীন বসবাস করেন।
সুবিন মুলমি নামে এফডব্লিউএলডির এক কর্মী বলেন, ‘কাগজে-কলমে আইন নারী-পুরুষ দুজনের জন্যই সমান। তবে রক্ষনশীল আমলারা এটি বৈষম্যমূলকভাবে নারীর ওপর প্রয়োগ করার সুযোগ নেবেন।’
মুলমি জানান, বাবার পরিচয় জানা নেই এমন ক্ষেত্রে বিলটিতে ছাড় দেয়া হয়েছে। যেমন- ধর্ষণ। তবে এক্ষেত্রেও সেটি প্রমাণের দায়িত্ব মায়ের।
আইন থাকলেও বাস্তবে যে এর প্রয়োগ নেই তার সাক্ষী অর্জুন কুমার শাহ। তার জম্ম নেপালে। বাবা ভারতীয় আর মা নেপালি। তত্ত্বগতভাবে ২০০৬ সালের আইন অনুযায়ী তার নাগরিকত্ব সনদ পাওয়ায় কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু ২৫ বছরের অর্জুন এখনও তার নাগরিক সনদ পাননি।
সংখ্যালঘু মাধেসি সম্প্রদায়ের এই তরুণ জানান, ‘আমি জম্মেছি এখানে, বড় হয়েছি এখানে, আমি নেপালি….কিন্তু এটি প্রমাণের জন্য এখনও কাগজের জন্য অপেক্ষা করছি আমি।’
নারী-পুরুষের এই অসাম্য দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেকে নেপালের রাজনীতিকে দুষছেন। তারা বলছেন, রাজতন্ত্র উৎখাত করে মাওবাদী ক্ষমতায় এলেও দেশটির শীর্ষ রাজনীতিবিদরা উচ্চবর্ণের হিন্দু। এ কারণে তারা এই অসাম্য টিকিয়ে রাখতে চান।
অর্জুনের আইনজীবী দিপেন্দ্র ঝাহ বলেন, ‘ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা কোনো ধরনের পরিবর্তন কিংবা সংযোজনের পক্ষে নয়। তারা পুরোনো ধারাটিই বজায় রাখতে চান।’
আগামী বছর নতুন সংবিধানের খসড়াটি পাস হলে স্বামী ছাড়া বসবাস করছেন এমন নারীদের পক্ষে তাদের সন্তানদের নাগরিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। এ কারণে ইতোমধ্যে রাজধানীতে এই বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন তারা। একইসঙ্গে অনলাইনেও চলছে তাদের দাবির স্বপক্ষে ক্যাম্পেইন।
নিজে নেপালের নাগরিক আর সন্তান রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক অধিকারটুকু পাবে না এটা ভাবতে চান না দিপ্তি গুরুং।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের কোনো পরিচয় নেই তাই কখনও কখনও মনে হয় এখানে নারীরা মানুষ নয়। আমি আমার সন্তানদের জম্ম দিয়েছি, তাদের প্রতিপালিত করেছি…তাহলে কেন আমার সন্তান নাগরিক স্বীকৃতি পাবে না? আমি কি এদেশের প্রকৃত নাগরিক নই?’
মন্তব্য চালু নেই