ওবামার বাবার গোপন চিঠির সন্ধান
বাবার যেসব চিঠি আজো পড়ে দেখেননি ওবামা
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের উত্তর দিকের একটি এলাকা হারলেম। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের বাস এখানে। সংস্কৃতি চর্চার জন্যও পরিচিতিও রয়েছে শহরটির। এই হারলেমেই অবস্থিত ‘স্কমবার্গ সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ব্ল্যাক কালচার’ নামের সংস্কৃতিকেন্দ্রটি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন চলার সব দলিল জীবন্ত করে রাখা হয়েছে এখানে।
ভাবছেন, হঠাৎ কেন স্কমবার্গ সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ব্ল্যাক কালচার নিয়ে আগ্রহ। তার আগে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। এই সংস্কৃতিকেন্দ্রের তিনতলায় জমে থাকা বাক্সের স্তুপে একটি চিঠি দেখে একদিন হঠাৎ করেই হোঁচট খান এখানকার সংগ্রহক। বাক্সের মুখ আলগা হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একগুচ্ছ কাগজ। সংগ্রাহক দেখতে পেলেন, অর্ধ-শতাব্দী পুরনো সব চিঠি আর দলিল-দস্তাবেজ। হলদে হয়ে যাওয়া কাগজগুলোতে চোখ বুলাতেই আশ্চর্য হয়ে যান তিনি। কারণ চিঠিগুলি যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পিতা সিনিয়র বারাক ওবামার লেখা।
চিঠিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতেও সময় লাগেনি সংস্কৃতিকেন্দ্রের প্রধান সংগ্রাহকের। দ্রুত হোয়াইট হাউজে খবর পাঠায় স্কমবার্গ সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ব্ল্যাক কালচার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নীরব থাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন। হোয়াইট হাউজ থেকে কোনো উত্তরও কিন্তু আসেনি। বাবার চিঠি পড়ে দেখার আগ্রহ আপাতত নেই বারাক ওবামার। জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষের পরই হারলেমে যাবেন তিনি। তার আগে নয় কেন? এ নিয়েই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
একটি সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন ওবামার বাবা সিনিয়র ওবামা
হারলেমের ওই সংস্কৃতিকেন্দ্রের চিঠিপত্র থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসছে। যে নামকে আজীবন বহন করে চলেছেন বারাক ওবামা, সেই বাবাকে কোনোদিনই ভালো করে চিনতে পারেননি তিনি। সুযোগটাই পাননি চেনার। আজকের ওবামা যখন মাত্র হাঁটতে শিখছেন, তখন তার ছোট্ট হাতটা ধরার জন্য পাশে থাকেননি বাবা। তিন বছরের ছেলে ও বউকে রেখে কেনিয়ায় ফিরে যান সিনিয়র বারাক ওবামা। এরপর মাত্র একবারই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন তিনি। ওবামার বয়স তখন ১০। বাবার স্নেহ, শাসন বা আদর কখনোই পায়নি ছোট্ট বারাক। তাই নিজে যখন বাবা হয়েছেন, দুই মেয়ে মালিয়া ও সাশাকে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেননি তিনি। সব সময় কাছে কাছে রেখেছেন দুই মেয়েকে।
প্রশ্ন, সিনিয়র বারাক ওবামা স্ত্রী-পুত্রকে ছেড়ে গেলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে জানতে হবে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে কেনিয়ার এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে যে যুবক আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন। অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী, নিজের স্বপ্নপূরণে নিরলস পরিশ্রমী ছেলেটির লড়াইটা ছিল অসম। কেনিয়া তখনও স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। ব্রিটিশদের উপনিবেশ। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের উচ্চশিক্ষা অনেকটা সোনার হরিণের মতো। তবে হাল ছাড়েনি সেই যুবক। খাদ্যের জন্য কখনো অডিটরের কাজ করেছেন, কখনো জরিপকারী হিসেবে চাকরি, আবার কখনো করেছেন ইনসিওরেন্স কোম্পানির ম্যানেজারি।
ওবামার মা ও বাবা
তবে এসবে আগ্রহ ছিল না কৃষ্ণাঙ্গ ওই যুবকটির। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলেন। আরো পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য দরকার টাকা। কে দেবে? সম্বল বলতে চোখ ঝলসানো একটা রেজাল্ট। যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কলারশিপে পড়তে চেয়ে চিঠি দিতে শুরু করলেন যুবকটি। একদিন হয়েও গেল। সুযোগ এলো যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এদিক সেদিক থেকে যাওয়ার টাকাও জোগাড় করলেন। প্রথমে নাইরোবি থেকে ইতালির রোম। রোম থেকে প্যারিস হয়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন সিনিয়র বারাক ওবামা। সেখান থেকে করে সোজা লস অ্যাঞ্জলেস। তারপরই হাওয়াই। চোখে একরাশ স্বপ্ন- পড়তে হবে, আরো অনেক পড়তে হবে।
অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার দৃষ্টিতে পড়ে যান সিনিয়র বারাক ওবামা। প্রতিভাবান, উজ্জ্বল এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রের উপস্থিতি টের পান সবাই। তার এক অধ্যাপক ছাত্র সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বারাক ওবামা লাখে একটা হয়। ওর প্রতিভার তুলনা হয় না। আগামীদিন ও গোটা আফ্রিকার গর্ব হবে।’ পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখিতেও আগ্রহ ছিল সিনিয়রের। অসম্ভব ভালো কথাও বলতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়েই বক্তব্য রাখতে হত তাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বাগ্মী হয়ে ওঠার পেছনের রহস্যটা এই গল্পগুলি থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। বাবার প্রতিভাটাই পেয়েছেন তিনি।
এদিকে প্রতিভাবান সিনিয়র বারাক ওবামার প্রেমে পড়ে যান মার্কিন ছাত্রী অ্যান ডানহ্যাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ওবামার সহপাঠী ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়েন অ্যান। এরপর বিয়ে করে নেন দুইজনে। ১৯৬১ সালে জন্ম হয় তাদের এক পুত্র সন্তানের। পরে যিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্দান্ত রেজাল্ট নিয়ে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে সম্পন্ন করেন সিনিয়র। এরপর মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য স্কলারশিপের আবেদন করেন জ্ঞান চর্চার আরেক পাদপিঠ হার্ভার্ডে।
স্কলারশিপ চেয়ে করা সিনিয়র ওবামার আবেদন
রেজাল্ট দেখে স্কলারশিপ দিতে দ্বিতীয়বার আর ভাবেনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। স্ত্রী আর একমাত্র পুত্রকে হাওয়াইতে রেখে হার্ভার্ড চলে যান সিনিয়র ওবামা। সেখানে মাস্টার্স শেষ করেন ঠিকই, কিন্তু আর হাওয়াইতে ফেরেননি তিনি। চলে যান নিজ দেশ কেনিয়ায়। কেনিয়ার নামী অর্থনীতিবিদ হবেন- এই স্বপ্নই তখন সিনিয়রের চোখে। সেইসঙ্গে আরেকটা টানও ছিল তার, যা স্ত্রী অ্যানের কাছে গোপন রেখেছিলেন সিনিয়র। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগেই কেনিয়ায় বিয়ে করেছিলেন তিনি। দেশে স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে সিনিয়র ওবামার। শুধু অ্যান নয়, ব্যক্তিগত জীবনের এই তথ্য তিনি গোপন রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছেও।
উচ্চাকাঙ্খী সিনিয়ার ওবামার স্বপ্ন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। ৪৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার। স্ত্রী, পুত্র আর পরিবারের টান উপেক্ষা করে যিনি এগোতে চেয়েছিলেন, অকাল মৃত্যু তার সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। প্রথমবার যখন কেনিয়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন তখনও বউ ছেলেমেয়ের কথা ভাবেননি। আবার সেখান থেকে কেনিয়ায় ফেরার সময়েও পিছুটান হয়ে দাড়ায়নি অ্যান কিংবা ছোট্ট বারাক। সেই শূন্যতাই হয়তো দীর্ঘদিন কুরে কুরে খেয়েছে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। বয়স যখন বিশ তখন একবার কেনিয়ায় গিয়েছিলেন বারাক ওবামা। তার ভাষায়, ‘অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েছিলাম। কিছু পেলাম, কিছু পেলাম না।’ আজো হয়তো উত্তর খুজে বেড়ান- কেন তার মায়ের কাছে আগের বিয়ের কথা লুকিয়েছিলেন বাবা? কেনই বা তাদের ছেড়ে চলেও গিয়েছিলেন?
বাবার সঙ্গে ১০ বছরের ওবামা
দিন কয়েক আগে কেনিয়ায় বসে এক টেলিফোন সাক্ষাত্কার দেন বারাক ওবামার চাচা সেইড ওবামা। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই যুক্তরাষ্ট্রে ফেলে আসা ছেলেকে খুব ভালোবাসতো। মাঝেমাঝেই ছবি বের করে দেখাতো। আর যুক্তরাষ্ট্রের ভাবির থেকে ছেলের রিপোর্ট কার্ড আনিয়ে গর্বের সঙ্গে সবাইকে দেখাতো। ছেলেকে ভালো না বাসলে তা সম্ভব নয়।’ সেইডের বক্তব্য, সিনিয়রের চিঠি আর দলিল-দস্তাবেজ পড়লে বাবা সম্পর্কে ধারণা পাল্টাতে বাধ্য ছেলের।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কি তবে হারলেমে গিয়ে দলিলগুলো দেখা উচিত? প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা সাবধানী মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাচা। তার ভাষায়, ‘তা বলতে পারব না। বাবা-ছেলের সম্পর্কে কোথায় কতটা গোপনীয়তা রয়েছে, তা কারো বোঝা সম্ভব নয়।’ কারো পক্ষেই আঁচ করা সম্ভব নয়, কোনোদিন বাবার চিঠি হাতে নিয়ে দেখবেন কি না বারাক ওবামা। আপাতত হারলেমের সেই সংস্কৃতিকেন্দ্রের ২১৪ নম্বর বাক্সটিতে বন্দি হয়ে রয়েছে সিনিয়র বারাক ওবামার নিজের হাতে লেখা নানান চিঠিপত্র।
মন্তব্য চালু নেই